চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির ১৩২ বছরের ইতিহাসে যা ঘটেনি, এবার তা–ই ঘটেছে। সমিতির আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে ‘বিরল’ ঘটনা প্রত্যক্ষ করল দেশের প্রাচীন এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম সংগঠনটির সদস্যরা। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন পরিচালনায় গঠিত নির্বাচন কমিশনের মুখ্য নির্বাচন কমিশনারসহ দু’জন পদত্যাগ করেছেন। এরপর গঠিত পুরো নির্বাচন কমিশন–ই বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। পরে গঠন করা হয়েছে নতুন নির্বাচন কমিশন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম বারের (জেলা আইনজীবী সমিতি) ইতিহাসে এমন ঘটনা ‘বিরল’। কেউ কেউ বলছেন, স্বাধীনতার পর এমন ঘটনা আর ঘটেনি। এর আগে ঘটেছে কিনা সে বিষয়ে রেকর্ড নেই। আবার কেউ কেউ জোর দিয়ে বলছেন, প্রায় ১৩২ বছরের পুরনো চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতিতে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ করার ঘটনা দ্বিতীয় আরেকটি ঘটেনি। একবার নির্বাচন কমিশন গঠন করার পর সেটি বাতিল করে নতুন করে আরেকটি নির্বাচন কমিশন গঠন করার ঘটনাও দ্বিতীয় আরেকটি ঘটেনি। সেই হিসাবে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে নতুন ইতিহাসই লিখল জেলা আইনজীবী সমিতি। ১৭ জন আইনজীবী নিয়ে ১৮৯৩ সালের ২৩ মার্চ চট্টগ্রাম জেলা বার অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। অবিভক্ত বাংলায় আলীপুর বার অ্যাসোসিয়েশন এবং চট্টগ্রাম জেলা বার অ্যাসোসিয়েশন (পূর্বের নাম) ১ম প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেক চড়াই–উৎরাই পেরিয়ে বর্তমানে সংগঠনটির রয়েছে ৭ হাজারের বেশি আইনজীবী। প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও আগামী ফেব্রুয়ারিতে সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে গত ৩০ ডিসেম্বর জেলা আইনজীবী সমিতি ৫ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন গঠন করে। এতে আইনজীবী এ এক এম মকবুল কাদের চৌধুরীকে মুখ্য নির্বাচনী কর্মকর্তা করা হয়। আইনজীবী মুজিবুর রহমান খান, কাজী মুহাম্মদ নাজমুল হক, মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী ও মুহাম্মদ কবির হোসাইনকে নির্বাচনী কর্মকর্তা করা হয়। এদের মধ্যে গত ৫ জানুয়ারি মুখ্য নির্বাচনী কর্মকর্তা এ কে এম মকবুল কাদের চৌধুরী ও নির্বাচনী কর্মকর্তা মুহাম্মদ কবির হোসাইন পদত্যাগ করে সমিতির সভাপতি, সেক্রেটারি বরাবর পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। পদত্যাগপত্রে মুখ্য নির্বাচনী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ‘গঠিত নির্বাচন কমিশনে বিগত অগণতান্ত্রিক সরকারের সমর্থকদের অন্তর্ভুক্তি থাকায় বিবেকের তাড়নায় দায়িত্ব পালন করতে অক্ষমতা প্রকাশ করছি। এ জন্য দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করলাম।’ নির্বাচনী কর্মকর্তা মুহাম্মদ কবির হোসাইন উল্লেখ করেন, ‘নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে বেশ কয়েকজন সদস্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যারা ইতিমধ্যে ৫ আগস্টের আগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নির্মম হত্যাকাণ্ডসহ অসংখ্য ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিমধ্যে যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বিরোধিতা করেছে তাদের সাথে একত্রে কোনো কর্মকাণ্ডে শরীক হওয়া এবং তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে বৈধতা দেওয়ার মত কাজে ব্যক্তিগতভাবে আমি শরীক হতে আগ্রহী না। উক্ত ফ্যাসিস্ট কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্তদের সাথে একত্রে দায়িত্ব পালন করা নীতি ও নৈতিকতা বিরোধী।’
সমিতি সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশন থেকে মুখ্য নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ দুজনের পদত্যাগের ঘটনা একেবারে নতুন হওয়ায় বারের সাবেক সভাপতি, সেক্রেটারির সাথে বৈঠকে বসে বর্তমান কার্যকরী কমিটি। করণীয় ঠিক করতেই এ বৈঠক হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের জন্য বলা হয়। কিন্তু পদত্যাগকারীরা তা করেননি। বারের গঠনতন্ত্রে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো বিধান না থাকা সত্ত্বেও এক প্রকার বাধ্য হয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। গত ৯ জানুয়ারি নতুন করে গঠিত কমিশনে আইনজীবী মুহাম্মদ এনামুল হককে মুখ্য নির্বাচনী কর্মকর্তা করা হয়েছে। আইনজীবী উত্তম কুমার দত্ত, তারিক আহমদ, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও মোহাম্মদ আলীকে নির্বাচনী কর্মকর্তা করা হয়।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সেক্রেটারি এ এইচ এম জিয়াউদ্দিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন করা যায় কিন্তু নতুন করে আরেকটি করার সুযোগ নেই। গঠনতন্ত্র এলাও করে না। এখন যেটি হয়েছে সেটি এখতিয়ার বহির্ভূত, বেআইনি। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে আইন পেশায় যোগদান করেছিলেন সুভাষ চন্দ্র লালা। পরবর্তীতে তিনি সমিতির সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিলেন। দৈনিক আজাদীকে তিনি বলেন, আমি চট্টগ্রাম জেলা বারে যোগদান করার পর মুখ্য নির্বাচন কর্মকর্তার পদত্যাগের ঘটনা চোখে পড়েনি। এর আগে অর্থাৎ ১৯৬৯ এর আগে এমন ঘটনা ঘটেছিল কী না সেরকম কথাও কখনো শুনিনি। এটি একেবারে ব্যতিক্রম একটি ঘটনা। কেন, কী কারণে নির্বাচন কর্মকর্তার পদ থেকে পদত্যাগ করতে হলো সেটি একমাত্র তারাই বলতে পারবেন।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. নাজিম উদ্দিন গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, একদমই নতুন ঘটনা। মুখ্য নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ দুজনের পদত্যাগের ঘটনা আগে কখনো দেখিনি এবং শুনিওনি। এ বিষয়ে আমরা সমিতির সাবেক সভাপতি, সেক্রেটারির সাথে বৈঠক করেছি। সেখানে হওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী
পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে বলা হয়। কিন্তু তারা সেটি করেননি। একপ্রকার বাধ্য হয়ে আমরা নতুন করে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করেছি। সমিতির স্বার্থে এবং সমিতির ভালোর জন্য আমরা এটি করেছি। আমরা চাইছি যে, ঠিক সময়ে নির্বাচনটা হোক। তিনি বলেন, আমাদের বারের গঠনতন্ত্রে এমন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। তবে একটি সেকশনে বলা হয়েছে, সমিতির মঙ্গলার্থে কার্যকরী পরিষদ যে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।