একাত্তরের জলপুত্র সুনীলের জন্মকথা
সুনীল কান্তি জলদাস ১৯৫২ সালে ১ জুলাই তারিখে পটিয়ার ভাটিখাইন ইউনিয়নের করল গ্রামের জলদাস পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা–যামিনি জলদাস, মাতা পাখি বালা জলদাস। সুনীল জলদাস ছিলেন যামিনি দাশের দ্বিতীয় পুত্র। প্রথম পুত্র পুলিন কান্তি জলদাস। সুনীল কান্তি জলদাস পরিবারের ছোটো ছেলে হওয়াতে পরিবারের সবাই তাঁকে পছন্দ করত। যামিনি দাশের খুব আদরের সন্তান ছিলেন সুনীল জলদাস।
ছেলেবেলা ও কর্মজীবন
যামিনি দাশের স্বপ্ন ছিল সুনীলকে পড়ালেখা করাবেন। ছোটোবেলায় সুনীল কান্তি জলদাস প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও অভাব অনটনের কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার ইতি টানতে হয়। যামিনি জলদাসের পক্ষে একা সংসারের খরচ চালানো ছিল বেশ কষ্টের। সুনীল তাঁর বাবা যামিনি জলদাসের কথা ভেবে তাঁর পূর্বপুরুষদের আদি পেশায় জড়িয়ে পড়লেন। নদীতে খালবিলে গিয়ে জাল পেতে মাছ ধরা এবং সে মাছ হাটবাজারে নিয়ে বিক্রি করা। ভোরবেলায় বড়ো জাল কাঁধে নিয়ে কিংবা কখনো মাছের টুকরি মাথায় নিয়ে বাপ চাচাদের পিছু পিছু ছুটে যেত সুনীল। কখনো নদীতে কখনো বা খালেবিলে গিয়ে জলে নেমে মাছ ধরার জন্য জলের সাথে যুদ্ধ করত। সুনীল ছোটোবেলা থেকে ছিলেন বেশ দুরন্ত ও সাহসী প্রকৃতির। সন্ধ্যাবেলায় সাদা ধুতি পরিধান করে শরীরে তৈল মেখে বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডাবাজি আর আনন্দ স্ফুর্তি করে বেলা পার করে দিতেন। সুনীলের কণ্ঠ ছিল বেশ সুমধুর। সুনীল তাঁর সুরেলা কণ্ঠে গান গেয়ে শুনাতেন। বিভিন্ন সামাজিক ও পুজোর অনুষ্ঠানে অরগান ও জোঁরখায় বা মাদল, ঢাকঢোল বাজাতে পছন্দ করতেন মঞ্চ নাটকে অভিনয়ও করতেন। ফুটবল খেলায় ছিলেন বেশ পারদর্শী। সুনীল ছিলেন বাবা ভক্ত। তাঁর পিতাকে যেমন সম্মান করতেন তেমনি ভয় পেতেন। কখনো বাবার অবাধ্য হতেন না। ডাক শুনলে দৌড়ে গিয়ে গামছা পরিধান করে ছুটে যেতেন খালে–বিলে কিংবা পুকুর নদীনালায়। মাছ ধরতে না পারলে তাঁদের পরিবারের হেঁশেল ঘরে আগুন জ্বলতো না। অনেক সময় বাজারে গিয়ে মাছ বিক্রি করে ন্যায্যমূল্যও পেতেন না। অনেকে জোর করে ধমক দিয়ে বাকিতে মাছ নিয়ে যেতেন। বড়ো মাছ পড়লে অনেক সময় মহাজন নিয়ে যেতেন। গোধূলিবেলায় ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরতেন সুনীল।
সহযোদ্ধাদের স্মৃতিতে মুক্তিযোদ্ধা সুনীল কান্তি জলদাস
জলদাস পাড়ার দুরন্ত কিশোরটি ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীরা যখন বাঙালিদের উপর পৈশাচিক নির্যাতন, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, বাঙালিদের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে স্টিম রোলার চালিয়ে যাচ্ছিল ঠিক সেসময় রাজনীতির কবি স্বাধীন বাংলার স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমানের কালজয়ী ভাষণ শুনে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। রাতের অন্ধকারে আবু তাহের খান গ্রুপের সাথে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ভারতের দেমাগ্রীতে চলে যান।
চন্দনাইশ উপজলোর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা জাফর আলী হিরু বলেন, ৭১–র মুক্তিযোদ্ধা সুনীল কান্তি জলদাস নিষ্পেষিত পরিবারের সন্তান। সুনীল বেশ সাহসী প্রকৃতির ছেলে। তৎকালীন সময়ে এক নম্বর সেক্টরে সে যুদ্ধ করেছিল। সে সময় তিনটা গ্রুপ ছিল– মাহাবুব গ্রুপ (চকরিয়া) জলিল বকশু গ্রুপ ও আবু তাহের খান কসরু গ্রুপ (১৫৪ নং গ্রুপ দোহাজারি)। সুনীল জলদাস আবু তাহের খান গ্রুপের সদস্য ছিলেন। তাঁদের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, মেজর রফিকুল ইসলাম । সুনীল কান্তি জলদাস ভারতের দেমাগ্রী থেকে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর সহযোদ্ধারা ছিলেন আবু তাহের খান গ্রুপে সুনীলের সহযোদ্ধা, বর্তমান চন্দনাইশের এমপি নজরুল ইসলাম সাহেব, জাফর আলী হিরু, অনিল কান্তি, আকবর খান, মাহফুজুর রহমান, মুসলিম হোসেন ও নুরুল ইসলাম সহ আরও অনেকে।
তিনি আরও বলেন, সেসময় নাকি সবাই মিলে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ভারতের মিজোরাম পাহাড়ের দেমাগ্রী এলাকায় অবস্থান করেন। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে বেশকিছুদিন সেখানে অবস্থান করেন। শেষে ভারতের হরিণা খাইন থেকে অস্ত্র নিয়ে সবাই দেশে ফিরেন। ফেনীর মুহুরী নদী পার হয়ে ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া ও কর্ণফুলি নদী হয়ে বোয়ালখালী দিয়ে চন্দনাইশ থানার হাসিমপুর গ্রামের পূর্ব সীমান্ত পাহাড়ের পাদদেশে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন চালায়, সেই অপারেশনে সুনীল বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। সেই যুদ্ধে জলিল বকস গ্রুপের সুবাস মজুমদার ও দিমল কান্তি নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন।
সে সময় খবর আসে পাক বাহিনীরা পটিয়ার কিছু প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করেছে। পরবর্তীতে পটিয়ার আশিয়া গ্রামের কেরেইঞ্জা খাল সংলগ্ন মেলঘর গ্রাম এবং পটিয়া বুধপুরা হয়ে পিঙ্গলার বড়ুয়া পাড়ায় মুক্তিবাহিনী দুপুর একটা পর্যন্ত অবস্থান করেন। পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থান করার খবর পেয়ে নেড়ি কুকুরের মতো মাথা নীচু করে পালিয়ে যান। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর থেকে ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত দোহাজরী থেকে যান সুনীল কান্তি জলদাস। দোহাজারীর রেলস্টেশনের বিশ্রামকক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত ছিল। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে আসার পর ভারতীয় সৈন্যরা বিভিন্ন এলাকার মতো দোহাজারীতেও মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র নিয়ে নেয়। যুদ্ধ পরবর্তী যে যার পেশায় ফিরে যায়। করল গ্রামের জলদাস পাড়ার দামাল ছেলেটি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর আদি পেশা ছাড়েননি। জলদাস পাড়ায় এসে মাছ ধরার পাশাপাশি তিনি বাড়তি আয়ের জন্য বেশ কিছুদিন রিকশাও চালিয়েছেন পটিয়া শহরে।
একসময় মুক্তিযোদ্ধা সুনীল কান্তি জলদাস তাঁদের বটবৃক্ষ মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের খানকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়লেন। সুনিলের মুক্তি সনদ নং – ০২০২০৪০১০১( সেক্টর–১) পটিয়া, ভাটিখাইন। একদা বন্যার ছোবলে মুক্তিযোদ্ধা সুনীলের সার্টিফিকেটসহ আর গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র বন্যার পানিতে ভেসে গেল।
একাত্তরের সুনীলের পরিবারে অভাবের শেষ ছিল না দু’মুঠো অন্ন জোগাতে তাঁদের অনেক কষ্ট করতে হতো। সংসারের অভাব অনটনের হাল ধরার জন্য মুক্তিযোদ্ধা সুনীল তাঁর সন্তানদের একবেলা খাওয়ালে আরেক বেলা খাওয়াতে পারতেন না। একসময় মুক্তিযোদ্ধা সুনীল কান্তি জলদাস তাঁর পরিবার নিয়ে ১৯৮৬ সালের দিকে সপরিবার নিয়ে চলে যান উত্তর কাট্টলীর লতিফপুরের জলদাস পাড়ায়।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জাফর আলী হিরু বলেন, “একদিন আমার বাসায় নাশতা নিয়ে হাজির মুক্তিযোদ্ধা সুনীল কান্তি জলদাস। এসে হাউমাউ করে কান্না করে বললেন, দাদা আমাদের নেতা আবু তাহের খান কসরু ভাইকে মেরে ফেলল, আমি কার কাছে যাব? আমার মুক্তিযুদ্ধের যে কাগজপত্র ছিল সব বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। আমি নিঃস্ব। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। আপনি কিছু একটা করেন। মুক্তিযোদ্ধা জাফর আলী হিরু তখন ডেপুটি কমান্ডার। তিনি তাঁকে কম্পিউটার প্রিন্টের একটি কাগজ দেন। পরবর্তীতে তিনি সার্টিফিকেট পেয়েছিলেন। দীর্ঘদিন আর তাঁর কোনও খোঁজ পাননি। কেউ খোঁজও নেননি মুক্তিযোদ্ধা সুনীল কান্তি জলদাসের। আর্থিক কষ্ট ও চিকিৎসার অভাবে সুনিলের মারা যাওয়ার খবরটি শুনে খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। সুনীল বেঁচে থাকা অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা ভাতা না পেলেও বর্তমানে তাঁর স্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাই। আজ একটা কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন সময়েও যুদ্ধক্যাম্পে সুনীল গান–বাজনা করে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অনুপ্রেরণা যোগাতেন। যুদ্ধ শেষে যখন সবাই ক্যাম্পে জড়ো হতাম তাঁর কন্ঠে গান শুনে মুক্তিযোদ্ধারা সবাই অনুপ্রাণিত হতাম। সেই স্মৃতিগুলো সত্যি ভুলার নয়।”
পরিবারের স্মৃতির ঝাঁপি থেকে
মুক্তিযোদ্ধা সুনিল কান্তি জলদাসের পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে, তাঁর প্রথম সন্তান নিখিল জলদাস বর্তমানে স্ট্রোক করে শারীরিক প্রতিবন্ধী। দ্বিতীয় ছেলে মিন্টু জলদাস চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করে বাবার আদি পেশা জলদাসগিরি করে সংসারের হাল ধরেছেন। তৃতীয় জন টিংকু জলদাসও সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে শিক্ষাজীবনের ইতি টানে। সেও এখন নদীতে মাছ ধরে। চতুর্থ জন সুমন জলদাস সেও মাছ ব্যবসায়ী। ছোটো ছেলে রাজন জলদাস। হাকিম আলী ডিগ্রি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বর্তমানে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করছেন। দুই মেয়ে আলো জলদাস ও নয়ন জলদাস। আলো জলদাস বিবাহিত। ২০০১ সালের দিকে সুনীল কান্তি জলদাসের শরীরে বাসা বাঁধে দুরারোগ্য লিভার ক্যানসার। তাঁর মেজো ছেলে মিন্টু জলদাস বলেন, জলদাসের ছেলে বলে কেউ কাছে ঘেঁষতে দিত না। মুক্তিযোদ্ধা বাবা আমাদের জন্য অনেক কষ্টে করেছেন। বাবা অনেকদিন বাঁচতে চেয়েছিলেন। খুব মনে পড়ছে বাবা আমাকে ফুটবল খেলার জন্য বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে যেতেন। তিনিও তাঁর বাবার মতো ভালো ফুটবল খেলে এলাকায় বেশ নাম করেছেন।” সুনীলের স্ত্রী শোভারানী জলদাস বলেন, “চিকিৎসা করার জন্য আর্থিক সাহায্য চাইতে অনেকের দুয়াওে দুয়ারে গিয়েছিলাম, অনেকের বিষবাক্য হজম করতে হয়েছে। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তাঁরা বলেন, জেলে পরিবারে জন্মগ্রহণ করাই ছিল বড়ো পাপ। তা না হলে কেন এত বৈষম্য কেন জাত নিয়ে এত বিরূপ আচরণ ভেদাভেদের প্রহসন? সবার রক্তের বর্ণ লাল। ৭১ এই দেশ স্বাধীন করার জন্য ধর্ম–বর্ণ–জাত নির্বেশেষে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু বড় কষ্ট লজ্জার কথা আমরা স্বামী জলদাস বলে কেউ এগিয়ে আসেনি। শাড়ি আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে শোভারানী জলদাস অঝোরে কেঁদে ফেলেন।
আহা জেলে পরিবারের নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! এজন্য বোধহয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে লিখেছিলেন, “জেলে পাড়ার ক্রন্দন কখনো থামে না। ঈশ্বর থাকেন ঐ ভদ্রপল্লীতে”।
সুনীলের বড়ো ভাই পুলিন কান্তি জলদাস ও তাঁর স্ত্রী শোভারাণী ঋণ নিয়ে তাঁর বড়ো মেয়েকে বিয়ে দেন। সুনীলের চিকিৎসা ব্যয় বহন করার মতো তাদের সামর্থ ছিল না। হায়রে সোনার বাংলাদেশ। যে কি না মা মাটির টানে শিকড়ের টানে, লাল সবুজের বিজয় নিশানের জন্য স্বাধীনতার জন্য ৭১ সালে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সেই জলপুত্র মুক্তিযোদ্ধা সুনীলের চিকিৎসা সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। সুনীলের ভাই পুলিন কান্তি জলদাস বলেন “ভেজা শরীরে মাছ বিক্রি করতেন বাজারে। স্বাধীন দেশে সেখানেও স্বাধীনভাবে চলতে পারেননি আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাই সুনীল। মহাজনদের অত্যাচার আর হয়রানির জন্য। অনেকে জোর করে মাছ নিয়ে যেত বিনা পয়সায়। কত ভদ্র পল্লির লোকজন গ্রামের মাতব্বর বড়ো সওদাগর পয়সা দিবে বলে বড়ো মাছ নিয়ে গেছেন বাকিতে। কত সওদাগরের কাছে মাছের পাওনা টাকা চাইতে গিয়ে লাঠিপেটা ও জুতা পেটাও হজম করতে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সুনীল জলদাসকে।
সহপাঠি ও বাল্যবন্ধুর স্মৃতিতে সুনীল
নলিনী কান্ত মেমোরিয়াল ইশকুলের শিক্ষক সন্তোষ মাস্টার বলেন “বীর মুক্তিযোদ্ধা সুনীল কান্তি জলদাস ছিল আমার খুব কাছের বন্ধু। দুজনে একসাথে ইশকুলে আসা যাওয়া করতাম। সুনীল ভালো ফুটবল খেলতেন। তাঁর গানের গলা ছিল অনবদ্য। করল গ্রামের যে কোনও অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করতেন সুনীল। একসাথে গান বাজনা খেলা–ধুলা বিশেষ করে মাঘী পূর্ণিমায় ঠেগর পুনি গ্রামের বুড়াই গোসাইয়ের বৌদ্ধ মন্দিরে মেলা বসত। দুজন মিলে মেলায় যেতাম। বাঁকখালী খালের একটি সাঁকো ছিল। রাতের বেলায় ঐ পথে হেঁটে যেতে মানুষ ভয় পেত। বন্ধুরা মিলে যখন সুনীলসহ ধানী জমির আইল ধরে হাঁটা আরম্ভ করতাম, ঝিঁঝিঁ পোকা ঝিঁ ঝিঁ করছে। মাঝে মাঝে বিলের মাঝখান থেকে শিয়াল হাঁক তুলছে হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া করে। সুনীল বলত কিরে সন্তোষ খুব ভয় করছে ? আমার পাশ দিয়ে কালো কি একটা জানি হেঁটে গেছে। সুনীল বলত হেসে বলেন, ওটা বনের হাতি। মনে রাখবি তোর বন্ধু সুনীল পাশে থাকলে তোকে বাঘেও স্পর্শ করতে ভয় পাবে বলে হেসে উঠত। চিকিৎসার অভাবে সুনীলের চলে যাওয়া আমি নিতে পারিনি।”
সুনিল জলদাসের পরিবারের সাক্ষাৎ নিতে গিয়ে আমি নিজেও আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়লাম, কখন যে চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ল টেরও পাইনি। আহা একাত্তরের জলপুত্র !
একসময় মুক্তিযোদ্ধা সুনীল কান্তি জলদাসের শরীরে বার্ধক্য বাসা বাঁধে। লতিফপুরের ঝুপড়ি ঘরের মেঝের ছেঁড়া মাদুরে নেতিয়ে পড়ল ৭১–র জলপুত্র সুনীল কান্তি জলদাস। গত ৫ জুলাই ২০০২ সালে সুনীল জলদাস সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান। লতিফপুরের (উত্তর কাট্টলীতে) ভেড়ির বাঁধের পাড়ে মহাশ্মশানে তার শবদাহ সম্পন্ন করা হয়।
স্মৃতিতে একাত্তরের জলপুত্র সুনীল
মুক্তিযোদ্ধা সুনীল কান্তি জলদাস স্মৃতি বিজড়িত জলদাস পাড়াটি আজও ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে। নেই শুধু মুক্তিযোদ্ধা সুনীল কান্তি জলদাস। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫১টি বছর কেটে গেল। পটিয়ায় যে সুনীল কান্তি জলদাস নামে একজন জেলে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সে খবর তাঁর গ্রামে মানুষও জানে না। একাত্তরের শহীদ ছবুর ফেইসবুকগ্রুপ ও ইতিহাসের খসড়ার সহযোগিতায় এবং গত ১৭ মার্চ ২০২২ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশুদিবসে সুনীল স্মৃতি বিজড়িত করল সুমঙ্গল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে “সুনীল কান্তি জলদাশ শিশুতোষ পাঠাগার স্থাপন করা হয়। পাঠাগারটির উদ্বোধক ছিলেন, বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত(২০২৩) ইতিহাসের খসড়ার সম্পাদক লেখক ও গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হক। চলতি বছরে অমর একুশে বইমেলায় শৈলী প্রকাশন থেকে আমার লেখা “একাত্তরের জলপুত্র” মুক্তিযোদ্ধা সুনীল কান্তি জলদাস নামে বই প্রকাশিত হওয়ার পর বিস্মৃত অধ্যায় সুনীল সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম জানতে পারেন। একজন নিম্নশ্রেণির নিষ্পেষিত পরিবারের সন্তান জেলে মুক্তিযোদ্ধা সুনীল যে কিনা জলের সাথে যুদ্ধ করে সংসার চালাতে একাত্তরে মা মাটি মাতৃভূমির টানে অস্ত্র কাঁধে তুলে নেন। সুনীল ছিলেন একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। এসেছে আবার স্বাধীনতার মাস সুনীলদের জন্য এই লাল সবুজের পতাকা উড়ছে বাংলার মাটিতে। সুনীল নেই তাঁর নিষ্পেষিত অসহায় বিধবা স্ত্রী ও সন্তানরা লতিফপুরের জেলেপেড়ায় জরাজীর্ণ ঝুপড়ি ঘরে থাকে। সুনীল জলদাসের বিধবা স্ত্রী শোভারানী জলদাস ছোট একটি কুঁড়ে ঘরের জন্য মাননীয় প্রধান মন্ত্রীমহোদয় এবং মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের প্রতি আকুল আবেদন করেছেন, প্রয়াত জেলে মুক্তিযোদ্ধা সুনীলের পরিবারের প্রতি যেন ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেন। পরিশেষে স্যালুট জানাই একাত্তরের জলপুত্র মুক্তিযোদ্ধা সুনীল কান্তি জলদাসের প্রতি।