আমার প্রিয় বিষয় হচ্ছে, যথাক্রমে প্রিয় মানুষ হচ্ছে আমার বাবা মা, এঁরা আমার উপর খুব প্রভাব বিস্তার করেছেন। আমি একটা ছোট বই লিখেছিলাম আমার পিতার মুখ নাম দিয়ে। সেখানে পিতার কথাটাই প্রধানত আছে, কিন্তু এটা আমি লেখার সময় অনুভব করেছি এবং অনুভব করি যে, যদিও ওটাকে পিতার মুখ বলেছি কিন্তু পিতার পিছনে মাতাও আছেন, এবং আসল কথা হচ্ছে আমার পিতার মধ্যেও মাতৃসুলভ গুণগুলো ছিল এবং স্বভাবও ছিল বলতে পারি। মা যেমন সন্তানকে লালন পালন করেন, আমার পিতাও সেরকম করতেন, ১৯৬৫ সালে আমার বাবা মারা যান, আমি তখন বিদেশে ছিলাম, সেজন্য তখনই তাৎক্ষণিকভাবে আমার যে অনুভূতি তৈরি হয়েছিল সেগুলো আমি একটি বড় প্রবন্ধের আকারে লিখেছি এবং সেটা পরে বইয়ের একটি অংশ করে আমার পিতার মুখ নাম দিয়েছি, কিন্তু আমার মা’ও আমার প্রিয় মানুষ। বাবার মৃত্যুর পর দীর্ঘসময় তিনি আমাদের সাথে ছিলেন এবং তাঁর প্রভাবটা খুব বেশি করেই পড়েছে আমার উপর। আমার বাবা বাইরে থাকতেন সরকারি কর্মোপলক্ষে, অতএব মায়ের প্রভাবটা আরো বেশি ছিল আমাদের উপর। আমরা যেহেতু পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করি, পিতাই যেহেতু সংসারের প্রধান সেজন্য বাবার প্রভাবটাকে আমরা মোটামুটি চিহ্নিত করতে পারি, কিন্তু মায়ের প্রভাবটাকে করতে পারি না, তবু আমার কাছে বাবার মতোই সমান প্রিয় মা।
প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যদি একজনের কথাই বলি তাহলে আমি বেছে নেবো মওলানা ভাসানীকে, তাঁর কিছু দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমি একমত না, তাঁর বিরুদ্ধে আমার প্রধান অভিযোগ যে, তিনি ধর্ম এবং রাজনীতিকে আলাদা করার ব্যাপারে সাহায্য করেন নি, এটা আমাদের দেশের রাজনীতির জন্য, আমাদের সমাজের জন্য খুব ক্ষতিকর বিষয় হয়েছে।
যাকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলা হয়, যাকে ইহজাগতিকতা বলা হয় এটা আমরা সৃষ্টি করতে পারিনি আমাদের রাজনীতিতে, আমাদের সমাজে। মওলানা ভাসানী এই দু’টোকে মিশিয়ে ফেলেছিলেন ধর্ম এবং রাজনীতিকে আলাদা করতে পারেননি, মানে আমাদেরকে সাহায্য করেননি। কিন্তু মওলানার যে গুণটা আমার ভালোলাগে সেটা হচ্ছে তিনি সাম্রাজ্যাবাদ-বিরোধী এবং সামন্তবাদ-বিরোধী রাজনীতিক ছিলেন। আমরা তাঁর সময়েও পাইনি তাঁর পরেও পাইনি, অমন রাজনীতিক। এই দুই প্রশ্নে তিনি অনমনীয় ছিলেন, আমরা দেখেছি কেউ কেউ, সামন্তবাদ বিরোধী হন কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হন না, আবার কেউবা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হন কিন্তু সামন্তবাদ বিরোধী হন না। কিন্তু মওলানা তাঁর যে সংস্কৃতি তাঁর যে পটভূমি সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি সাম্রাজ্যবাদকে চিনলেন এবং সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যে পুঁজিবাদ আছে তাকেও তিনি চিহ্নিত করেছেন, আর অন্যদিকে যে সামন্তবাদী বন্ধনগুলো জমিদারি প্রথা থেকে শুরু করে অর্থাৎ কৃষকদের উপর যে নানারকম মহাজনি নির্যাতন এটাও তিনি দেখেছেন এটাও তাঁর প্রধান গুণ। আর দ্বিতীয় যে গুণটি সেটা হচ্ছে মওলানা ক্ষমতার জন্য রাজনীতিটা করেননি, সকলেই রাজনীতি করে ক্ষমতার জন্য, ক্ষমতা দখল করার জন্য, অথচ তাঁর মধ্যে আমি দেখেছি যে তিনি ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেননি, তিনি ক্ষমতায়ন করতে চেয়েছিলেন জনসাধারণকে। জনসাধারণকে ক্ষমতায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, সেজন্য তিনি কোনো দলে টিকে থাকতে পারেননি। ক্ষমতার রাজনীতিতে তিনি কখনো বিশ্বাসী ছিলেন না। দেশের বাইরে আমার প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব লেনিন। সমাজ বদলের যে রাজনীতি, তিনি সে রাজনীতি করেছেন। সে রাজনীতি রাষ্ট্র ক্ষমতা নেবার জন্য রাজনীতি নয়, সে রাজনীতি সমাজ বদলের রাজনীতি। তাঁর ভেতরে কোনো আপসকামিতা ছিল না, যাঁরা বিপ্লবী রাজনীতি করেন তারা অনেক সময় একপেশে হন। কিন্তু লেনিন সাহিত্যে উৎসাহী ছিলেন, সংগীতে উৎসাহী ছিলেন, অনরবত লিখতেন, পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল, শক্তি ছিল তাঁর অর্থাৎ লেনিন একজন পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন। বহুমাত্রিক মানুষ ছিলেন।
সাহিত্যিকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আমার খুবই প্রিয়, তাঁর কাছে আমরা সব সময় যেতে পারি, যে কোনো প্রয়োজনে যেতে পারি, যেমন আনন্দের জন্য যেতে পারি। আমাদের বাংলা গদ্যকে বিদ্যাসাগর প্রাণ দিয়েছেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেই প্রাণটাকে আরো বিকশিত করেছেন এবং বহুমাত্রিকতা দিয়েছেন। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ বারবার পড়া যায়, বহুভাবে পড়া যায়। এরপরে বিশ্বসাহিত্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখক হচ্ছে শেক্সপীয়র। তাঁর প্রিয় লেখক হবার স্থূল কারণ হচ্ছে আমি পেশায় ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষকতা করেছি, কাজেই শেক্সপীয়র আমাকে পড়তে হয়েছে ছাত্রজীবনে, পেশাগত জীবনে যদি এ পেশায় জড়িতও না থাকতাম তাহলেও আমি শেক্সপীয়রকে সবচে প্রিয় লেখক বলতাম, এজন্য যে, তাঁর মধ্যে আমি যে গুণটা দেখি সেটা সর্বজন প্রশংসিত এবং সর্বজন স্বীকৃত। সেটা হচ্ছে তিনি তাঁর কালের মানুষ, তাঁর পরিস্থিতির মানুষ, তাঁর দেশের মানুষ, কিন্তু তিনি সর্বজনীন, তাঁর ভেতরে সর্বজনীনতা ছিল। তিনি এমন সব চরিত্র তৈরি করেছেন যেগুলো চিরকালের মানুষ, একালেরও মানুষ। তাঁর ভেতরে শুধু নাট্যগুণ নয় কাব্যগুণও দেখি। তাঁর কাব্যগুণও বৈচিত্র্যপূর্ণ। দুই প্রিয় লেখকের কথা বললাম, আরেকজন প্রিয় লেখক হচ্ছে টলস্টয়। তিনি আরেক ধরনের লেখক। তিনি সম্পূর্ণ গদ্যের লেখক, উপন্যাসের লেখক, তাঁকেও আমার ভালো লাগে। প্রত্যেকটা মানুষ যে অসাধারণ প্রাণী সেটা টলস্টয় যেভাবে তাঁর লেখায় উপস্থাপিত করেছেন তা কম লেখকই করতে পেরেছেন। হোমারের লেখার মধ্যেও আমরা ওই ব্যাপারটা পাই। কিন্তু তাঁর প্রত্যেকটা চরিত্র স্বতন্ত্র। এটা আমরা টলস্টয়ের মধ্যে দেখি, যেমন তাঁর যুদ্ধ ও শান্তি উপন্যাসের মধ্যে পাঁচশোর মতো চরিত্র আছে, পাঁচশো চরিত্রকে তিনি স্বতন্ত্রভাবে দেখেছেন, প্রত্যেকটা চরিত্র তাঁর কাছে আলাদা আলাদা মানুষ, এমনকি তাঁর কুকুরটাও আলাদা, তাঁর এই যে একটা পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা, দাবির অন্তর্দৃষ্টি ছিল তা অসাধারণ। তাঁর আরেকটি গুণ আমার আরো ভালোলাগে তা হচ্ছে সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর ধারণা, তিনি মনে করেন যে, সাহিত্য হচ্ছে একধরনের যোগাযোগ, মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ করে লেখা তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা তাঁর উপলব্ধি এগুলোকে অন্যের মধ্যে সংক্রমিত করতে চান, এটা তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন। অন্যের মধ্যে সংক্রমিত করাই হচ্ছে লেখকের দায়িত্ব। তাঁর এই বোধ এবং বিশ্বাসটা-এটা আমার কাছে বেশ গ্রহণযোগ্য। সাহিত্যের কাজ হচ্ছে কেবল লেখা নয়, আনন্দ দেয়া নয়, আনন্দের মধ্যে একটা সংক্রমণ ঘটানো, এই গভীরতা এই ব্যাপকতা আমায় বেশ আলোড়িত করে। আমি বহু লেখকের লেখা পড়ি এবং পড়েছি উপরে উল্লেখিত তিনজনকে আলাদা করে দেখি এবং তিনজনকে আমি মনে করি আমার প্রিয় লেখক।
কবিদের মধ্যে আমার প্রিয় জন কীটস এবং জীবনানন্দ দাশ। কীটস এবং জীবনানন্দের মধ্যে একটা সাযুজ্য আছে। সেটা হচ্ছে তাঁদের দু’জনের মধ্যে একটা রহস্যময়তা আছে, দ্বিতীয়ত এই দুই কবির মধ্যে একটা সময় এবং ইতিহাস চেতনা আছে।
আমার প্রিয় চলচ্চিত্রকার চার্লি চ্যাপলিন। তাঁর ছবি আমার খুব ভালোলাগে এবং আমি খুব উপভোগ করি। চ্যাপলিনের কৌতুক ব্যঙ্গবিদ্রুপাত্মক হলেও মানুষের প্রতি তাঁর যে দরদ আছে তা আমার বেশ ভালোলাগে। আমি আইজেনস্টাইনের ছবিগুলোও খুব পছন্দ করি, সত্যজিৎ রায়ের ছবি, মৃনাল সেনের বাংলা ছবি খুব প্রিয়।
অভিনেতা অভিনেত্রীদের মধ্যে আমার প্রিয় লরেন্স অলিভিয়ের। বাংলা ছবির মধ্যে অনেকেই আমার প্রিয় ছিলেন। ছবি বিশ্বাস, বাল্যকালে খুব পছন্দের ছিলেন। তাঁর বাচনভঙ্গি আমার খুবই প্রিয় ছিল, তারও আগে প্রমথেশ বড়ুয়ার কিছু ছবি আমরা দেখেছি তাঁকেও পছন্দ করি। কিন্তু ছবি বিশ্বাস আমাদের খুব পছন্দের ছিলেন। জহর গাঙ্গুলীকে আমরা খুব পছন্দ করতাম তাঁর নিজস্বতার কারণে। কানন দেবীকে ভালোলাগতো। উত্তম-সুচিত্রার ছবি আমরা দেখেছি, যখন আমরা কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্র, তখন তাঁরা খুব জনপ্রিয়। পেইন্টিং-এ আমার প্রিয় পিকাশো। তিনি বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং ক্রমাগত নিজেকে পরিবর্তন করেছেন, বলা যায় এটা তাঁর বহুমাত্রিকতা। দ্বিতীয় কথা তাঁর মধ্যে একটা অঙ্গীকার ছিল। সামাজিক রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক। যেটা খুব ভালো লাগতো। আমার প্রিয় শিল্পী জয়নুল আবেদীন। তাঁর সমস্ত ছবির মধ্যেই আমি একটা বলিষ্ঠতা দেখতে পাই। যে বলিষ্ঠতা বাঙালি জীবনের মধ্যে আছে হয়তো কিন্তু সাধারণত এটা চোখে পড়ে না।
আমি সঙ্গ প্রিয়, কিন্তু বেশি লোকের আড্ডা পছন্দ করি না। ঘনিষ্ঠ লোকদের মধ্যে আলাপ আলোচনাটুকু আমি খুব উপভোগ করি। অনেক মানুষের হৈ চৈ এসব আমার ভালোলাগে না। আড্ডা কথাটা আমার কাছে খুব অপ্রয়োজনীয় মনে হয়, আমি বিশেষ করে যাদের সাথে রুচিতে মেলে, দৃষ্টিভঙ্গিতে মেলে তাদের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করি। কিন্তু আড্ডা কথাটা আমার কাছে আলস্য মনে হয়, তবে যারা লেখেন, যারা চিন্তা করেন তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগটা খুবই জরুরি, বিশেষ করে সমমনাদের মধ্যে।
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণটা আমার কাছে প্রবলভাবে নাড়া দেয়া প্রিয় মুহূর্ত। আমার কাছে মনে হতো এটা অনেকদিনের একটা কঠিন রোগ একটা দুঃসহ রোগ সেটা কেটে গেল। যখন শুনলাম তারা আত্মসমর্পণ করবে, ওই মুহূর্তটা বেশ নাড়া দেয়। আমি তো মনে করি এটা একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এবং ওই মুহূর্তে আমি জড়িতও ছিলাম, এই অর্থে যে, আমরা দেশের ভিতর অবরুদ্ধ ছিলাম এবং আমি নিজে জানতাম যে আমার দুই রকমের বিপদ, একটা বিপদ হচ্ছে আমি নাগরিক হিসেবে বাঙালি, আরেকটা বিপদ হচ্ছে চিহ্নিত লোক হিসেবে টিক্কা খানের সমন বার্তা পেয়েছি এবং তারা খুঁজছে এবং এটা পরে প্রমাণিতও হয়েছে যে, ১৪ ডিসেম্বর আমার অনেক সহকর্মী বন্ধু শহীদ হয়েছেন। আমিও তালিকায় ছিলাম কিন্তু আমি বেঁচে গেছি, সেটা এইজন্যেই যে আত্মগোপনে থাকায় আমার ঠিকানা তাদের জানা ছিল না, কাজেই আমি জানতাম যে আমি দুইভাবে বিপন্ন।
বিজয়ের পঞ্চাশ বছরে দাঁড়িয়ে নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমরা অজস্র ত্যাগ, আত্মত্যাগে স্বাধীনতা অর্জন করেছি সত্য, কিন্তু সেই স্বাধীনতাকে সর্বস্তরে এবং সকল মানুষের দ্বারে পৌঁছে দিতে পারিনি। স্বাধীনতার ওই আনন্দ স্বাধীনতার পর আর এগোয়নি, ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছে। একটি গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। অথচ কাঙ্ক্ষিত সেই স্বপ্নপূরণ গত পঞ্চাশ বছরে আর এগোলো না। আমরা আশাবাদী বলেই প্রতিটি স্বাধীনতা দিবসে প্রত্যাশা রাখি কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নপূরণে। একটি বৈষম্যহীন, শ্রেণিহীন সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। সেজন্য আমাদের আরো ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, তাতো মিথ্যে নয়।
লেখক : শিক্ষাবিদ; ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়