মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চট্টগ্রামের রয়েছে অভূতপূর্ব সাফল্য ও বীর গাথা। ১৯৭১সালের ২৬ মার্চ সর্বপ্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা করা হয় চট্টগ্রাম থেকে। পাক প্রতিরোধেও সর্বপ্রথম বিজয়ের কেতন ওড়ায় চট্টগ্রামের কুমিরায় বাঙালি ইপিআর জোয়ানেরা ক্যাপ্টেন সুবেদ আলীর নেতৃত্বে। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায় কুমিরায় পাক কনভয়ের অগ্রযাত্রা থাকিয়ে দেয়। এক পাক ব্রিগেডিয়ার জেনারেলসহ ১৫২ জন পাক সৈন্য ও ১৪ জন স্বাধীনতাকামী ইপিআর জোয়ান প্রাণ হারান। পাশাপাশি ৩ ও ৪ মার্চ পাহাড়তলি ও আমবাগান এলাকায় বাঙালি ও অবাঙালির মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সহ ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা আসে চট্টগ্রামের লাল দিঘির ময়দান থেকে। আন্দোলন–সংগ্রামের সূতিকাগার বলা হয় চট্টগ্রামকে। মুক্তিকামী সাধারণ–জনতা একের পর এক স্বাক্ষর রেখে চলছে। এসব রক্তক্ষরণ ইতিহাসে মাইল ফলক হয়ে থাকবে।
৭০ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয় হন। বিজয় দল আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে, এটি সাংবিধানিক নিয়ম। কিন্তু পাক সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা শুরু করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলি ভূট্টো জাতীয় অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে। শেষতক বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ সর্বাত্মক আন্দোলন ঘোষণা দেয় । এ আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অভূতপূর্ব সাড়া দেয় মুক্তিকামী জনতা।
৩ ও ৫ মার্চ সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের পাহাড়তলি ও আমবাগান এলাকায় বাঙালি ও পাকপন্থি অবাঙালির মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। বাঙালিরা শান্তিপূর্ণ হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করলে অবাঙালি বিহারিরা অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত হয়ে মিছিলের ওপর হামলা চালায়।
তৎকালীন দৈনিক ইত্তেফাক–এর চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মাঈনুল আলম এক প্রবন্ধে লিখেন, ‘৭ মার্চের ভাষণের পূর্বে ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করেন। এই দাবী আদায়ে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশ প্রত্যহ সকাল হতে অপরাহ্ন, ২টা পর্যন্ত হরতাল ঘোষণা করেন। ৪ ঠা মার্চ ভোর হতে এক অভূতপূর্ব ও স্বতঃস্ফূর্ত সার্বিক হরতালে চট্টগ্রামের সকল কর্মকাণ্ড এবং জনজীবন স্তব্ধ হয়ে যায়…দুপুরের দিকে খবর পেলাম, ঝাউতলা, ওয়্যারলেস কলোনি হতে পাহাড়তলীর দিকে অবাঙালি ও বাঙালির মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ, গৃহে আগুন দেয়া এবং গুলিবর্ষণ হচ্ছে… আবারও খবর পেলাম, অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে অধিকাংশই বাঙালি…’ এসকল নিহতদের একজন আবুল কালাম ছিলেন বাঙালি। তিনি ভিক্টোরিয়া জুট মিলের শ্রমিক ছিলেন। নগর ছাত্রলীগ নেতা মোহাম্মদ ইউনুস সহ ছাত্রলীগ নেতারা তার মৃতদের উদ্ধার করে চট্টগ্রামের চৈতন্য গলির কবরস্থানে দাফন করে। অন্যদিকে গ্রেপ্তারকৃতদের একজন চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ ছাত্রলীগ নেতা অহিদুল আলম ও অপরজন হারুন ভূঁইয়া। সিটি কলেজের ছাত্রলীগ নেতা হারুণ ভূঁইয়ার বাড়ি সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ডে।
এ প্রতিরোধ সংগ্রামের অগ্রভাগে ছিলেন পলিট্রেকনিক ইনস্টিটিউটের ভিপি ও ছাত্রলীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ আল হারুন , ছাত্রলীগ নেত ফাইম উদ্দিন ফাইম, নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাবের হোসেন আজগরী, স্থানীয় সরাইপাড়া এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা খলিল সওদাগর ও চট্টগ্রাম রেলওয়ের হেডক্লার্ক ও ইপিআরএল–এর পাহাড়তলী শাখার সভাপতি বারিক মিয়াসহ অসংখ্য বাঙালি জনতা। জাতিগত এ সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে ফৌজদারহাট শিল্প এলাকায়, ঢাকার পুরনো ইয়ারপোর্ট কুর্মিটোলা, পাকিস্তানের শিয়ালকোট ও সারগোদা কেন্টরমেন্টেও। সর্বশেষ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দেয়ু ‘আপনাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ুন। এভাবের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’
২৫ মার্চের মধ্যরাতে একাধিকবার বঙ্গবন্ধু পক্ষে স্বাধীন ঘোষণা–বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান এমন একটি সংবাদ ২৫ মার্চ অপরাহ্নে এসে সীতাকুণ্ড পোস্ট মাস্টারকে জানান। সার্ব–পোস্ট মাস্টার পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য রাতের জিরো আওয়ারে টেলিগ্রাফে একটি বার্তা গ্রহণ করেন। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে এ বার্তা পৌঁছে দেন। ২৬ মার্চ ভোর রাতে থানা ছাত্রলীগ নেতা এসএম হাসান ও আবুল কালাম আজাদ সহ ছাত্রলীগ নেতারা চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের নেতা এমআর সিদ্দিকীর টয়োটা জিপে মাইক বেঁধে ট্রাঙ্ক রোডের দক্ষিণ ফৌজদারহাট হতে উত্তর সীতাকুণ্ড সদর দিকে ঘোষণা করতে করতে দ্রুত ছুটে আসেু ‘ প্রিয় দেশবাসী, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যার যা কিছু আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুন, রাস্তায় গাছ কেটে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।‘
অনুরূপ ভাটিয়ারী এলাকার রেলওয়ের প্রথম শ্রেণির কন্ট্রাকটার সুলতান আহমেদ চৌধুরীর টেলিফোনে, ৫১৫৫১ নাম্বারে একটি বার্তা আসে ২৫ মার্চ মধ্য রাতে। তিনি সংবাদটি তাঁর ছোটভাই আওয়ামী লীগ নেতা মুছা আহমেদ চৌধুরীসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের জানান। শেষতক স্বাধীনতা ঘোষণা বার্তা টোবাকোর শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ উল্লাহ ভুঁইয়ার কাছে পৌঁছে। মুহাম্মদ উল্লাহর বাড়ি বেগমগঞ্জ থানা। তিনি চট্টগ্রাম বিটিসি‘রও শ্রমিক নেতা ছিলেন। সঙ্গতকারণে নগর আওয়ামী লীগের নেতাদের চিনতে ও জানতেন। তিনি সাইকেল চালিয়ে বার্তাটি নিয়ে চট্টগ্রামে ছুটে যান এবং ঘোষণা বার্তার হেন্ডকপি কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার বাসায় ও সিটি অফিসে পৌঁছে দিয়ে আবারও ভোর–রাতে বানুবাজারস্থ টোবাকোর বাসায় সংগোপনে ফিরেন। এদিকে স্বাধীনতার ওই বার্তাটির একটি কপি নিয়ে সলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশনে যান ভাটিয়ারী আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কাসেম প্রকাশ কাসেম রাজা, ভাইস চেয়ারম্যান বদিউল আলম ও আবু জাফর। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বার্তাটি ওয়্যারলেস টাওয়ারের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে প্রচার করা। ওই ওয়্যারলেসে চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন হাকিম সাহেব। হাকিম সাহেবের ভাগিনা ইব্রাহিম খলিলকে বাসা গিয়ে প্রাইভেট পড়াতেন ছলিমপুর আব্দুল্লাঘাটা এলাকার আলী হোসেনের ছেলে বশির আহমেদ প্রকাশ বশির মাস্টার। তিনি ওইদিন দুপুরে ইব্রাহিমকে পড়াতে গেলে ইঞ্জিনিয়ার হাকিম সাহেব তাঁকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা বার্তা আসার কথা জানান। অতঃপর সিলিমপুর (ছলিমপুর) ওয়্যারলেস মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ২৬ মার্চ সকালে চট্টগ্রাম বহির্নোঙরে নোঙর করা বিদেশি জাহাজ নিজ নিজ দেশ ও অফিসে বার্তাটি জানিয়ে দেয়। ‘নিউইয়র্ক টাইম‘ বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার ছবি ছাপানো হয়। পাশে লেখা হয় ‘স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক।‘
এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ঘোষণাবার্তা সমপ্রচারের বিষয়টি আঁচ করতে পারে পাকজান্তা। চট্টগ্রাম নেভি ওয়্যারলেস ও সলিমপুর নৌ–বেতার ওয়্যারলেস একই ফ্রিকোয়েন্সিতে প্রচারিত হয়। পরে সন্দেহ প্রতিকারে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বেতার কর্মীদের ওপর নেমে আসে অত্যাচারের স্টিম রোলার।
২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমানও চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। ওসময় উপস্থিত ছিলেন বেতার কেন্দ্রটির স্টাফ ও গীতিকবি বেলাল মোহাম্মদ। ২৮ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান দ্বিতীয় আরেকটি ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। প্রথমটি তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান পরিচয় দেন। ২৮ মার্চ ঘোষণা বার্তাটি পাঠ করেন বঙ্গবন্ধুর নামে।
২৬ মার্চ জননেতা এমএ হান্নান চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে থেকে যে ঘোষণাটি বিশেষ বুলেটিন হিসেবে পাঠ করেন, সেটি হলো : ‘প্রিয় দেশবাসী, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, আপনাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকুন, পাক–হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করুন। লাঠি–সোঁটা দা–ছোরা মরিচের গুঁড়া নিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ুন।‘ তিনি সকালে দেওয়ানহাটের মোড়ে উপস্থিত জনতার সম্মুখেও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে দেশবাসীকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও প্রাবন্ধিক।