মুকুন্দ দাস চারণ কবি ও স্বদেশী গানের রচয়িতা হিসেবে সুখ্যাত। গানের পাশাপাশি তিনি স্বদেশী যাত্রাপালাও রচনা করতেন। অবিভক্ত বাংলায় বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে তাঁর গান সাধারণ মানুষকে উদ্বেলিত করতো মুক্তির প্রেরণায়।
মুকুন্দ দাসের জন্ম ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে ১৮৭৮ সালে। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল যজ্ঞেশ্বর। জনৈক সাধকের কাছে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নিলে সাধক গুরু তাঁর নাম দেন মুকুন্দ দাস। পিতার কর্মসূত্রে তাঁরা বরিশালে স্থায়ী হয়েছিলেন এবং মুকুন্দ দাস বরিশালকেই আন্তরিকভাবে ভেবে নিয়েছিলেন তাঁর জন্মভূমি বলে। বরিশালে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা অশ্বিনীকুমার দত্ত প্রতিষ্ঠিত ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে মুকুন্দ দাসের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি। ‘সত্য-প্রেম-পবিত্রতা – ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের এই আদর্শ মুকুন্দ দাসের মানসগঠনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এই স্কুলে পাঁচ বছর লেখাপড়া করেন তিনি। এরপর আর পড়াশোনা এগোয় নি। দায়িত্ব নেন বাবার মুদির দোকানের। এই দোকানে পাড়ার লোকেরা এসে আড্ডা দিত, গান-বাজনা হতো। উনিশ বছর বয়সে মুকুন্দ কীর্তন গায়ক বিরেশ্বর গুপ্তের কীর্তন দলে যোগ দেন। মুকুন্দ দাসের কণ্ঠ আর গায়কী ছিল অসাধারণ। দেখতেও ছিলেন চমৎকার। অচিরেই তিনি বীরেশ্বরের প্রধান সঙ্গী হয়ে উঠলেন। পরবর্তীকালে নিজেই তৈরি করলেন একটি গানের দল। মুকুন্দের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় থেকে বিপ্লবী অশ্বিনীকুমার দত্তের সাথে দেশহিতৈষী কাজে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন সহ ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি ছিলেন সদা সক্রিয় – কী গানে, কী যাত্রাপালায়, কী কর্মে। এ জন্যে তাঁকে অনেকবার কারাভোগ করতে হয়েছে। নিজের গান ও যাত্রার মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী গণআন্দোলন জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। মুকুন্দ দাস বেশ কিছু গ্রন্থও রচনা করেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে: ‘সাধন সংগীত’, ‘পল্লীসেবা’, ‘ব্রহ্মচারিণী’, ‘সাথী’ ইত্যাদি। ‘মাতৃপূজা’ বইটির পাণ্ডুলিপি ব্রিটিশ পুলিশ বাজেয়াপ্ত ও নষ্ট করে ফেলে। মুকুন্দ ছিলেন অসামপ্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। আবহমান বাংলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন তিনি। তাঁর ছিল উদার, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর গান ছিল মানবতার গান। ১৯৩৪ সালের ১৮ই মে মুকুন্দ দাস প্রয়াত হন। বাঙালির জাতীয় জীবনের যেকোনো দুঃসময়ে, গণআন্দোলনে সদাই তিনি আমাদের স্মরণ্য।