ফের সেনা অভ্যুত্থান ঘটল মিয়ানমারে। সেনাদের হাতে আটক হলেন স্টেট কাউন্সিলর (প্রধানমন্ত্রী পদের সমান) অং সান সু চি, যিনি দীর্ঘ ১৫ বছর গৃহবন্দি থাকার পর ২০১০ সালে মুক্তি পেয়েছিলেন। এছাড়া আটক করা হয়েছে দেশটির প্রেসিডেন্ট উইন মিন্তকেও। গতকাল সোমবার ভোরে তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি সে দেশের প্রথম সারির রাজনীতিকদের অনেকেরই হদিস মিলছে না।
গত নভেম্বরের নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে দেশের সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে টানাপড়েন চলছিল। এর জের ধরে এই সামরিক অভ্যুত্থান বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি। ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) মুখপাত্র মিও নয়েন্ট জানান, সোমবার (গতকাল) ভোরে রাজধানী নেপিডোতে অভিযান চালিয়ে তাদের শীর্ষ নেতাদের আটক করা হয়েছে। এর কয়েক ঘণ্টার পর সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশনে এক বছরের জন্য দেশে জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা দেওয়া হয়। এছাড়া আগামী ১ বছরের জন্য দেশের দখল নেওয়ার কথা জানিয়েছে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা মিয়াওয়াদি টিভি। টেলিভিশনে ওই ঘোষণায় বলা হয়, গত নির্বাচনে ‘জালিয়াতির’ ঘটনায় সরকারের জ্যেষ্ঠ নেতাদের আটক করা হয়েছে। জরুরি অবস্থা জারি করে মিয়ানমারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাবাহিনীর সিনিয়র জেনারেল মিং অং হ্লাইংয়ের হাতে। বিবিসি লিখেছে, মিয়ানমারের বিভিন্ন প্রদেশে সেনা সদস্যরা প্রাদেশিক সরকারের প্রধানদের বাসায় বাসায় গিয়ে তাদের আটক করছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। এনএলডির মুখপাত্র নয়েন্ট রয়টার্সকে বলেছেন, যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সু চি ছাড়াও প্রেসিডেন্ট উয়িন মিন্ট এবং অন্যান্য জ্যেষ্ঠ নেতারা আছেন। নিজেও গ্রেপ্তার হতে পারেন- এমন ধারণা করছেন জানিয়ে নয়েন্ট বলেন, আমি আমাদের জনগণকে বলতে চাই, চটজলদি প্রতিক্রিয়া জানাবেন না এবং চাই তারা আইন অনুযায়ী কাজ করুক।
গতকাল সোমবার থেকেই নতুন পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভোররাতের দিকে থেকেই রাজধানীতে ফোন লাইনগুলোতে প্রবেশ করা যাচ্ছিল না। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, নেপিডোর পাশাপাশি মিয়ানমারের প্রধান শহর ইয়াঙ্গনেও সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। সব ব্যাংক সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে বলে দেশটির ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এসব বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য দেশটির সামরিক বাহিনীর মুখপাত্রকে ফোন করা হলেও তিনি ‘উত্তর দেননি’ বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
ফের হুমকিতে গণতন্ত্র : ১৯৬২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রায় পাঁচ দশক সেনা শাসন কার্যকর ছিল মিয়ানমারে। সে সময় দীর্ঘ ১৫ বছর গৃহবন্দি করে রাখা হয় সু চিকে। গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অহিংস লড়াইয়ের জন্য ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান তিনি। এরপর তার দল এনএলডি জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসে ২০১০ সালে মুক্তি পান সু চি। ২০১২ সালের উপ-নির্বাচনে ৪৫টি আসনের মধ্যে ৪৩টিতে জয়ী হয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হয় সু চির দল। এরপর ২০১৫ সালের নির্বাচনে এনএলডি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। সেই সরকারের মেয়াদ শেষে গত বছরের ৮ নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি বড় জয় পায়। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যেখানে ৩২২টি আসনই যথেষ্ট, সেখানে এনএলডি পেয়েছে ৩৪৬টি আসন। কিন্তু সেনাবাহিনী সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) ভোটে প্রতারণার অভিযোগ তুলে ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের দাবি তোলে। দেশটির নির্বাচন কমিশন অনিয়মের অভিযোগ নাকচ করলেও উত্তেজনা বাড়তে থাকায় মিয়ানমারে ফের সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করা হচ্ছিল।
বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেদক জনাথান হেড বলেন, মিয়ানমারের সেনবাহিনী এক দশক আগে যে সংবিধান রচনা করেছিল, সোমবারের সামরিক হস্তক্ষেপ সেই সংবিধানেরই সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অথচ গত শনিবারও সেনাবাহিনী সংবিধান মেনে চলার অঙ্গীকারের কথা বলেছিল। সু চির মত নেতাদের আটক করার ঘটনা উস্কানিমূলক এবং খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি পদক্ষেপ, যা তীব্র বাঁধার মুখে পড়তে পারে।
জনমনে ক্ষোভ-উদ্বেগ : অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলের জেরে ইয়াংগুনের সড়কগুলোতে সেনাবাহিনীর সমর্থকদের জাতীয় পতাকা হাতে আনন্দ করতেও দেখা গেছে। কিন্তু পুনরায় গণতন্ত্রকে পদদলিত করে সেনাবাহিনীর এ ক্ষমতা দখলের গ্রহণযোগ্যতা দেশবাসীর কাছে আসলেই আছে কী? এ বিষয়ে এক প্রতিবেদনে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিং অং হ্লাইংয়ের ক্ষমতা দখলে কিছু মানুষ রাস্তায় নেমে আনন্দ করলেও আপামর জনসাধারণের মনে উদ্বেগ, ক্ষোভ আর হতাশা বিরাজ করছে। ইয়াংগুনের বাসিন্দা ৩২ বছরের জিজাওয়াহ রয়টার্সকে বলেন, আমার খুব রাগ হচ্ছে। আমি আর সামরিক শাসন দেখতে চাই না। তিনি বলেন, তারা যেটা করছেন সেটা স্বৈরতন্ত্র। আমরা সবাই জানি আমরা কাকে ভোট দিয়েছি।
থেইনি ওও নামে একজন বলেন, আইন অনুযায়ী আমাদের একটি নির্বাচন হয়েছে। জনগণ যাকে পছন্দ করে তাকে ভোট দিয়েছে। আমাদের এখন আইনগত আর কোনও সুরক্ষা রইল না। আমরা খুবই অনিরাপদ বোধ করছি, আতঙ্ক, উদ্বেগের মধ্যে আছি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইয়ানকিন জেলার ১৯ বছরের এক তরুণী বলেন, আমি সকাল থেকে দুইবার বাজারে গেছি। আমি চাল এবং অন্যান্য খাদ্য পণ্য কিনেছি। আমি জানি না কী ঘটছে। আমি একটু আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি। অভ্যুত্থানের ফলে জনগণ উদ্বিগ্ন হলেও এর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের রাস্তায় বিক্ষোভে নামার কোনো লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না। ছাত্র নেতা সি থু তুন বলেন, আমাদের দেশ একটি পাখির মত ছিল, যে মাত্র উড়তে শিখছিল। এখন সেনাবাহিনী আমাদের ডানা ভেঙে দিয়েছে। তবে শুধু সেনা অভুত্থানের বিপক্ষে নয় কেউ কেউ পক্ষেও কথা বলছেন। একজন জাতীয় ভিক্ষু ফেইসবুকে এক ভিডিও পোস্টে বলেন, আজ জনগণের খুশির দিন।
জরুরি অবস্থা শেষ হলে নতুন নির্বাচন : মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বলছে, জরুরি অবস্থা শেষ হলে দেশটিতে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। সেনা অভ্যুত্থানের কয়েক ঘণ্টা পর এমন তথ্য জানানো হয়।
সামরিক বাহিনীর ফেসবুক পেইজে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা প্রকৃত বহু-দলীয় গণতন্ত্র চর্চা করবো… যেখানে পূর্ণ ভারসাম্য এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে।’ বিবৃতিতে আরো বলা হয়, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর এবং জরুরি অবস্থা শেষ হয়ে যাওয়ার পর ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।
এ পর্যন্ত যা ঘটলো : (১) অং সান সু চিকে গ্রেপ্তার। (২) এক বছরের জরুরি অবস্থা ঘোষণা। (৩) মিয়ন্ত সোয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ। (৪) আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগের ক্ষমতা গ্রহণ সেনাপ্রধানের। (৫) জরুরি অবস্থা শেষ হলে নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা। (৬) সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্ব নেতারা। (৭) সেনা অভ্যুত্থান হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত হবে না বলে আশা করছে বাংলাদেশ।