মিরসরাইতে নতুন সূর্যোদয় মোশাররফ যুগের অবসান, রোহেল যুগের আরম্ভ

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | শুক্রবার , ১৯ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

মিরসরাইতে সংসদীয় রাজনীতিতে নতুন সূর্য উদিত হয়েছে। উদিত সূর্যের নাম মাহবুবুর রহমান রোহেল, তিনি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়ে জয়ের মালা গলায় তুলে নিয়েছেন। অস্তগামী পুরাতন সূর্য হচ্ছেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। মোশাররফ ভাই বেঁচে থাকতে তাঁর পুত্রকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করে গেলেন। তাঁর বয়স হয়েছিলোরাজনীতির নাটাই তরুণদের হাতে তুলে দিয়ে স্বেচ্ছা অবসরে যাওয়ার কথা হয়তো ভাবছিলেন। এমনও হতে পারে সংসদীয় রাজনীতিতে পুত্রকে অভিষিক্ত করে নিজে যতদিন পারেন, রাজনীতিটা চালিয়ে যাবেন। দলীয় সভানেত্রী তাঁকে সম্মান করে প্রেসিডিয়ামের সিনিয়র সদস্য এবং পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য করেছেন। এর চেয়ে বেশি সম্মান আর কি হতে পারে? দু’বার মন্ত্রীও ছিলেন তিনি।

মোশাররফ ভাই একজন সুখী মানুষ, সফল রাজনীতিবিদ। তাঁর জীবনে সম্ভবত ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। তিনি যখন যে কাজে হাত দিয়েছেন, তাতে মুঠো মুঠো সোনা ফলেছে। ব্যর্থতার গ্লানি কখনো তাঁর জীবনকে স্পর্শ করতে পারেনি। ৭০এ যাদেরকে আওয়ামী লীগের টিকিট দিয়ে এমএ আজিজ এমপি বানিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র মোশাররফ ভাই সাতবার এমপি হয়েছেন, বাবু ভাই ছাড়া আর কেউ দু’বারও হতে পারেননি। বাবু ভাই, মোশাররফ ভাই পরস্পরের বন্ধু, কখনো বা প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিলেন। বাবু ভাই অন্য দিকে মোশাররফ ভাইকে ছাড়িয়ে গেলেও এমপি হয়েছিলেন তিনি চারবার, মোশাররফ ভাই’র চেয়ে তিনবার কম। কায়সার ভাই সত্তরের পর আর এমপি হননি, মনসুর ভাই (মির্জা মনসুর) এবং সাতকানিয়ার ছালেহ ভাই ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও স্বাধীনতার পর আর এমপি হননি।

মোশাররফ ভাই আর একটা দিকে তাঁর সমসময়ের সংসদ সদস্যদের ছাড়িয়ে গেছেন, সেটা হচ্ছে তিনি মন্ত্রী হয়েছেনএকবার নয়, দু’বার। মোশাররফ ভাই’র সৌভাগ্যকে হিংসে করতে হয়। ভাগ্যের সহায়তা পেয়ে পেয়ে তাঁর জীবনে ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে। মানুষের যত পাওয়া হতে পারে, একে একে সবই পেয়ে গেছেন তিনি, আর বোধ হয় কিছু পাওয়ার বাকি নেই।

সব কৃতিত্ব ভাগ্যকে দিলে মোশাররফ ভাইয়ের প্রতি অবিচার করা হয়। এতে মনে হতে পারে যে, মোশাররফ ভাই’র নিজের বোধ হয় কোন কৃতিত্ব নেই। আসলে তা নয়, সাফল্যের ডালা উপচে পড়া মোশাররফ ভাইয়ের যে জীবন আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, সেটি একটু একটু করে, তিল তিল করে তাঁর হাতে গড়ে তোলা কর্মকৃতির এক সত্য উপাখ্যান। মুক্তিযুদ্ধ থেকে দেশ, রাজনীতি ও মানুষের জন্য তাঁর মতো এমন করে নিজের জীবন ও যৌবনকে কেউ নিঃশেষে নিবেদন করেননি। মুক্তিযুদ্ধে তিনি জীবনকে দেশমাতার চরণে সঁপে নিয়ে মৃত্যুর সাথে হোলি খেলেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাড়ে তিন বছরের মাথায় আওয়ামী লীগের স্বর্গ থেকে পতন হয়। তারপর স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির উত্থানে গ্রহণ লেগেছিলো জাতির স্বাধীনতাসূর্যে; যখন বাংলাদেশ সর্বনাশের অন্তহীন গহবরের অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। সেই সমূহ ধ্বংস ও বিনষ্টির কালে একাশিতে বিদেশে স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে স্বদেশ প্রত্যাগত বঙ্গবন্ধু কন্যার সঙ্গে যাঁরা অন্ধকারের উদর থেকে স্বাধীনতাসূর্য ছিনিয়ে এনে আলোকোজ্জ্বল প্রভাতের সূচনা করেছিলেন, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কখনো সন্ত্রাসীরা তাঁর পায়ের রগ কেটে দিয়েছিলো নিউ মার্কেটের মোড়ে, কখনো তাঁকে গুলি করা হয়েছিলো ফটিকছড়িতে; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের দুঃসাহসী বীর মোশাররফ ভাইকে যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঘায়েল করতে পারেনি, সেখানে বাংলাদেশের ফৌজি শাসকের ভ্রুকুটি, সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের শ্বেতসন্ত্রাস তাঁর কাছে নস্যি মাত্র। এভাবে মোশাররফ ভাই রাজনীতির পথে বৈরি শক্তির সমস্ত বিছানো কাঁটা উপড়ে ফেলে, সমস্ত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে আন্দোলনসংগ্রামে বিজয়ী হয়ে এবং অবশেষে একে একে সাত সাতটি নির্বাচনে শুধু তাঁর বিজয়ের বৈজয়ন্তীই উড্ডীন হয়েছে।

মোশাররফ ভাই’র পিতা সৈয়দুর রহমান সাহেব এমপি ছিলেন। তাঁর পুত্র রোহেলের বিজয়ের মাধ্যমে মিরসরাইবাসী তিন প্রজন্মের একটি সংসদীয় পরিবার পেয়েছে। তিনি এমপি ছিলেন, এখন তাঁর ছেলে মাহবুবুর রহমান রোহেল এমপি হয়েছে, তিন পুরুষের এক সংসদীয় গল্প হয়ে গেল।

বৃহত্তর চট্টগ্রামে আর একটিই তিন পুরুষের সংসদীয় পরিবার পাওয়া যায়। সেটি হচ্ছে খান বাহাদুর আমান আলী, খান বাহাদুর আনোয়ারুল আজিম ব্যারিস্টার, অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিমতিন পুরুষের তিনজনই এমপি হয়েছেন। আর সব এক বা দু’এমপির পরিবার। মির্জা আবু আহমদ ও মির্জা আবু মনসুর দু’এমপির পরিবার, এ কে খান ও জহির উদ্দিন খান দু’বারের এমপির পরিবার, আহমদ কবির চৌধুরী ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দু’এমপির পরিবার, অধ্যক্ষ ওসমান সরওয়ার আলম ও সাইমুম সরওয়ার কমল দু’এমপির পরিবার, মৌলভী ফরিদ ও তাঁর দু’পুত্র খালেকুজ্জামান ও শহীদুজ্জামান এমপি হয়েছেন, কিন্তু তিন পুরুষের এমপি পরিবার নয়, দুই পুরুষের তিন এমপির পরিবার। বাঁশখালীর খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী ও তাঁর পুত্র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী দু’এমপির পরিবার, ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তাঁর পুত্র সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী দু’এমপির পরিবার এবং এ কে এম ফজলুল কবির চৌধুরী ও তাঁর পুত্র এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর পরিবার, দু’এমপির পরিবার।

লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা ও সংস্কৃতি সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপর্দা: ইসলামের অন্যতম ফরজ বিধান
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা