বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তের ওপারে বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে তীব্র গোলাগুলি হচ্ছে। সীমান্তের ওপারে চলমান সংঘাতের গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়ছে সীমান্তের এপারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। গতকাল রোববার সকালে মিয়ানমারের ছোড়া গুলিতে ২ বাংলাদেশি নাগরিক আহত হয়েছেন। তারা হলেন প্রবিন্দ্র ধর (৫৫) ও রহিমা বেগম (৪০)। আতঙ্কে গ্রাম ছেড়ে নিরাপদে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন সীমান্তবাসীরা। পরিস্থিতি বিবেচনায় সীমান্তবর্তী ৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সংঘাতময় মিয়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) অর্ধশতাধিক সদস্য। মিয়ানমারের এই সীমান্তরক্ষীরা গতকাল কয়েক দফায় বান্দরবান সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ সীমানায় ঢোকেন।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম গত রাত সোয়া ৮টায় জানান, তখন পর্যন্ত বিজিপির ৫৮ জন সদস্য বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা এখন আছেন বিজিবির হেফাজতে। এদের মধ্যে ৬ জন গুলিবিদ্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে।
জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়রা জানান, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারে অভ্যন্তরে সামরিক বাহিনীর সাথে আরাকান আর্মির তীব্র লড়াই চলছে। শুক্রবার একদিন বন্ধ থাকার পর ফের সংঘর্ষ শুরু হয়। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীর দুটি ক্যাম্প দখলে শনিবার মধ্যরাত থেকে লড়াই শুরু হয়। গোলাগুলি, মার্টার শেল নিক্ষেপ ও রকেট ল্যান্সারের বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে সীমান্তবর্তী নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম–তুমব্রুর বিস্তীর্ণ এলাকা। ওই দুটি ক্যাম্প আরাকান আর্মি দখল করে নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর কয়েকটি হেলিকপ্টার সীমান্ত এলাকায় মহড়া দিয়ে বোমা ছোড়ে।
তুমব্রু সীমান্তের ৩৩–৩৪ নম্বর সীমান্ত পিলার এলাকার মাঝামাঝি মিয়ানমারের তুমব্রু রাইট বিজিপি বিওপির অবস্থান। শনিবার রাত ৩টার দিকে বিজিপির ওই ক্যাম্পকে ঘিরে শুরু হয় গোলাগুলি। গতকাল দুপুর ২টা পর্যন্ত চলছিল। বিকালের দিকে গোলাগুলি কিছুটা থেমে থেমে চলে।
গোলাগুলির ঘটনায় ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু, কোনারপাড়া, বাজারপাড়া, পশ্চিমকূল, ভাজাবনিয়া ও বাইশফাঁড়ি এলাকার অনেক পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে।
এদিকে গতকাল ভোর থেকে ঘুমধুম ও তুমব্রুর সাথে সব ধরনের যাতায়াত সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে বিজিবি। এ ব্যাপারে বিজিবির পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি। পরে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানানো হবে বলে বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়ন সূত্র জানায়।
নিরাপত্তা বিবেচনায় ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রশাসন। স্কুলগুলো হচ্ছে বাইশফাঁড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু পশ্চিমকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রেজু গর্জন বুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ত্রিরতন চাকমা বলেন, ঘুমধুম–তুমব্রু সীমান্তের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবাই নিরাপদে আছে। পরিস্থিতির কারণে গতকাল ঘুমধুম মিশকাতুন্নবী দাখিল মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
ঘুমধুম ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ শফিক ও সৈয়দ আলম বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ঘর থেকে বেরুনোর উপায় পর্যন্ত নেই।
স্থানীয় ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদ বলেন, তুমব্রু সীমান্তবর্তী ৩টি গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়েছে। পশুপাখি ও মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে গেছে মানুষজন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নেয়া মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ভারী অস্ত্রশস্ত্রের শব্দে তুমব্রুতে থাকা যাচ্ছে না। আতঙ্কে সীমান্তবর্তী বসবাসকারী মানুষজন গ্রাম ছেড়ে দূরে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। সীমান্তের ওপারে চলমান সংঘাতের কয়েকটি গুলি ও মর্টার শেলের গোলা গতকাল এপারে এসে পড়েছে। ভারী অস্ত্রের আঘাতে সীমান্তবর্তী কয়েকটি ঘরবাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতের গুলি এসে পড়ে বাংলাদেশি ২ জন নাগরিক গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। তাদের একজন পুরুষ, অপরজন নারী। পরিস্থিতি বিবেচনায় সীমান্তবর্তী ৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যানবাহন এবং জনগণের চলাচল সীমিত করা হয়েছে। পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে। সীমান্তে বিজিবি টহল এবং নিরাপত্তা চৌকিগুলোতে শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিজিবি সতর্কাবস্থায় রয়েছে।
গুলিবিদ্ধ দুই সীমান্তরক্ষী হাসপাতালে : বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ২ জনকে কঙবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল রাত ৮টার দিকে বিজিবি সদস্যরা অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের কঙবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে আসেন। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, তাদের নাম জা নি মং ও নিম লাইন কিং।
কঙবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. আশিকুর রহমান বলেন, গুলিবিদ্ধ দুজনকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে আহত সীমান্তরক্ষীদের কয়েকজনকে কুতুপালংয়ের এমএসএফ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।