: তয় আমার কতা হইল্যো গিয়া , মায়মুনারে এই ঘরদোর আর ভিটি ছাইড়্যা যাওন লাগবো! মুখ ভর্তি জর্দা আর পানের পিক্ উগরে ফেলে রমিজ মেম্বার কথাটা বলেই ফেললো!
মায়মুনার শ্বশুর বাড়ির চারধারে সুপারির বাগিচা। বাড়ির বিস্তৃত উঠোন জুড়ে আম–জাম–কাঁঠাল ছাড়াও আরও কতোফল–পাকুড়ের গাছ ! ওই গাছগুলো বাড়িটাকে ছায়া দিয়ে রেখেছে। মায়মুনার শ্বশুর আরমান শেখ এ তল্লাটে একজন ছোটখাটো জোতদার ।
এমুহূর্তে রমিজ মেম্বারের রায় শুনে মায়মুনার বাপ্ কিংকর্তব্যবিমুড়! সেখানে জমায়েত হওয়া মহল্লার মানুষজনের কেউ কেউ মেম্বারকে সায় দেয়। আর মায়মুনার বাপের পক্ষের লোকজন এই রায় মেনে নিতে পারে না ! তারা কেবল অসহায় দৃষ্টি নিয়ে স্থান ত্যাগ করে ।
আজ দুপুরের পরেই দুই পক্ষের বেশ কিছু লোকজন শালিস নিষ্পত্তির জন্য জমায়েত হয়েছিল । উভয় পক্ষের সওয়াল–জবাব করতে করতে দিনের সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ে ।
: তোমরা উভয়পক্ষ স্ট্যাম্প সই কইরা আমার কাছে আইয়্যো। হেরপরে আমি সব দেখুমনে !
শালিস শেষ হলে সবাই বিদেয় হয় । মায়মুনার দিনমজুর বাপ আচম্বিতে যেন চেতন ফিরে পায় । তার মনে প্রশ্ন জাগে , এ–কী রায় দিলেন মেম্বার সাব !
নসিম মিয়া গরীব দিনমজুর হতে পারে ! তাই বলে আরমান শেখের বখে যাওয়া ছাওয়ালের সাথে তার ছোট্ট মাইয়াডার বিয়া, কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনা! রূপে–গুণে মাইয়াডা ছিল নসিম মিয়ার চোখের মণি। কিন্তু বছর দুয়েক আগে আরমান শেখের মাদকাসক্ত পোলার চোখে পড়ে পাশের গ্রামের কিশোরী বয়সের মায়মুনারে ! আরামান শেখের পোলা
বেনজির শেখ নিয়ত করে ওই মাইয়াডারে তার চাই..ই… চাই ! ওই মাইয়াডারে সে শাদী করবেই ।
আরমান শেখ বখে যাওয়া ছাওয়ালডারে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় ছাওয়ালের এই প্রস্তাব শুনে কিছুটা সুরাহা পেলো । আরমান শেখ ভাবলো ছেলেকে বিয়ে করিয়ে যদি তার মন টলানো যায় তবে ভালোই হয় । সংসারি হলে কিছু পরিবর্তনতো হবেই। সেদিনই আরমান শেখ তার পোলার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে নসিম মিয়ার কাছে লোক পাঠায় ।
নসিম মিয়া আকাশ থেকে পড়ে !
ঃ কী বলো! আমার মাইয়াডার এহন তক্ বিয়ার বয়সই হইল্যোনা ! আর তোমরা কও মাইয়্যা বিয়া দিতাম্ !
সোজা আঙুলে ঘি উঠবেনা! তাই আরমান শেখ ফাঁদ পাতে। মায়মুনার বাপেরে বশ্ করার জন্য তাদের দারিদ্র্যতাকে হাতিয়ার করে কিছু ধন–দৌলত দিয়ে প্রলোভিত করার চেষ্টা চালায় ।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেআইনি অনেক কিছু ঘটে যায় । ঠিক সেভাবেই নসিম মিয়ার ষোলো বছর বয়সী কিশোরী কন্যার সাথে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেনমোহরে মৌলভী সায়েব বিয়ে পড়িয়ে দেয় রমজান শেখের লম্পট ছেলের সাথে ।
বিয়ের প্রথম রজনী থেকে শুরু হলো মায়মুনার আকাশে কালো মেঘে ঢাকা এক প্রাণান্তকর জীবন। মায়মুনা শ্বশুর বাড়িতে এসে ভাবলো ওর স্বামী হয়তো আদর–সোহাগে ভরিয়ে দেবে! মায়মুনা চোখ খুলে দেখলো, ওর বাপের ভিটির ছোট্ট একটা কুঁড়ে থেকে একটি বড় বাড়িতে ওর ঠাঁই হয়েছে !
মায়মুনা বড় বাড়ি পেলো ঠিকই, কিন্তু ওর দুঃখ আরও বাড়লো । ও বুঝতে পারলো ওর স্বামী একজন মদ্যপ আর উচ্ছন্নে যাওয়া এক লম্পট। মায়মুনা বহু কষ্টে থেকেও বাপরে কিছু বুঝতে দেয় না ।
দিন গড়িয়ে যায়। কিন্তু মায়মুনার দুঃখতো আর চাপা থাকে না। শাদীর এক বছরের মাথায় মায়মুনা পোয়াতি হলো। ওর জঠরে জন্ম নিল এক মেয়ে শিশু।
এরপর মায়মুনার জীবন আরও দুর্বহ হয়ে উঠলো । আরমান শেখের বখে যাওয়া ছাওয়াল মায়মুনার মেয়ে শিশু প্রসব মেনে নিলনা। সে প্রচার করতে থাকলো এই মাইয়্যা তার না। কেউ কোনো প্রশ্ন তুললোনা। সবাই বলতে থাকলো এই মাইয়্যা শিশু অবৈধ ! সেসঙ্গে আরমান শেখও ছাওয়ালের দাবিই মেনে নিল। এদিকে সে মায়মুনার ওপর পাশবিক নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল।
দুমাস ধরে ইউনিয়নের রমিজ মেম্বার নানা ছলছুতোয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই বানোয়াট মোক্ষম রায় দিল আজ! এ রায় শুনে মায়মুনা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। নির্বাক মায়মুনার কোলে চার মাস বয়সী কন্যাশিশু। নসিম মিয়া তার অচেতন মেয়ের পাশে এগিয়ে যায়। সশব্দে বলে, আমি এ রায় মানতামনা ! ওরে মায়মুনা আম্মাজান… তুই হইলি গিয়া আমার
নয়নের মণি! তর লাগি আমি সদর আদালতে যাইমু! হামার ঘর–ভিটি বেচি দিয়্যা হামি হের লাগি লইড়্যা যামু।… মা তুই শান্ত হ !
মায়মুনার বুকে শিশুটি মায়ের স্তন্য চায়। শিশু কন্যাটিকে বুকে জাপটে ধরে মায়মুনা বাপের বিমর্ষ মুখের দিকে অশ্রুপূর্ণ চোখে তাকায় ।
: কী অইবো বাপজান
: চল্ তুই হামার লগে! নাতিনরেও লইয়্যা যামু !
: বাপজান পোড়াকপালিরে লইয়্যা তুমি কী করবা ?
: অই কতা কইসনারে আম্মা !
: দুখের সায়রে ভাইস্যা কই যামু বাপজান ?
: না–রে মা আমি তর লাগি সদর আদালতে যামু।
মায়মুনার চোখ অশ্রুভরা! ও কেবলই ক্লিষ্ট বাপের মুখের দিকে তাকায় অপার বিস্ময়ে !