মালিনীর ভেড়া

সুসেন কান্তি দাশ | বুধবার , ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৭:৩৯ পূর্বাহ্ণ

গাঁয়ের নাম ‘ফুলপুর’। পাড়ার স্বনামধন্য বড়বাবুর চোখ জুড়ানো ফুলের বাগান এর সাথে মিল রেখে গাঁয়ের নামকরণ হয়েছে। বড় রাস্তার পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলেই দিগন্ত জোড়া বাগানটি চোখে পড়ে। লালনীলখয়েরি কতো রঙিন ফুল ফুটে আছে বাগান জুড়ে। প্রতিদিন ফুলেফুলে উড়েঘুরে বেড়ায় অগণিত প্রজাপতি আর মৌমাছি। বাগানের কোথাও মধুপোকার মৌচাক দেখা যায়। এছাড়া সারাবেলা কতো চেনাঅচেনা পাখিরা এখানে উড়ে এসে মনের মিতালী গড়ে যায়। সকাল হতেই পাখিদের কিচিমিচি সুর, ভোমরের গুঞ্জন আর প্রজাতির উড়াউড়ি দেখেই বড়বাবুর মন ভরে যায়।

বাগানে কয়েকজন লোক ফুলগাছে জল চালে, সার ছিটিয়ে দেয়। কোথাও খড়, কুড়িয়ে, কোথাওবা অকারণ জেগে ওঠা লতানো অংশ হতে চারা গাছগুলি মুক্ত করে।

বাগানের মালি সবে একজন। তার নাম প্রিতু। সে দশ বছরের ছোট্ট মেয়ে। বাগানের ফুল গাছের যত্ন নিতে সে বেশ চাটু। কোন গাছের কেমন পরিচর্যা দরকার, কিভাবে গাছটির দ্রুত বুদ্ধি পাওয়া যায়সবই তার জানা। বাগানে ফুল গাছ সারিবদ্ধ করে লাগানো। প্রতিদিন শতোশতো দুর্বল চারা গাছগুলিকে সবল করে নেয়ার কাজটি বেশ ভালো করেই তার জানা।

প্রতিদিন চোখ জুড়ানো, মন জুড়ানো ফুলগুলি ঝরে পড়ার বহু আগে প্রিতু ফুলগুলি তুলে নেয়। আর অতি সযত্নে একটিএকটি করে মালা গেঁথে, কখনোবা তোড়া বানিয়ে রাখে। বড়বাবুর নির্দেশে সেই ফুলের মালা আর তোড়াগুলি পাঠানো হয়, দূরে বহু দূরে।

প্রিতু’র একান্ত ইচ্ছেতে ও পরম মমতায় পালন করা হয়েছে একটি ভেড়া। বেশ নাকুসনুদুস পশমে ঢাকা শরীর তার। ভেড়াটি বেশ দ্রুত ছুটছে জানে। প্রিতু’র কাজকে অনেকটা সহজ করে দিতে জানে।

ফুলপুর গ্রাম পেরিয়ে ধানী জমির পাশ ঘেষে ছোট্ট রাস্তা বেয়ে অন্য একটি গাঁয়ের শেষপ্রান্তে বড়বাবুর আনন্দের মহড়া বসে। এখানকার গাঁয়ের কোণে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আসে একটি পাহাড়। প্রতি শীতের মৌসুমে এ পাহাড়ের বুকে বরফ জমে। ভোরের সোনালী রোদের ছটায় এই পাহাড়ের বরফ সোনারঙে চিকচিক করে। ক্রমে শেষ বেলাকার রঙিন আলোর সময় ধরে এমনি করে রূপের আলোয় চিকচিক করে। লোকে এই পাহাড়কে ‘সোনার পাহাড়’ আখ্যা দিয়েছে।

প্রতিদিন কাছের দূরের ভ্রমণ বিলাসী মানুষেরা এখানে বেড়াতে আসে। অনেকেই পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠার স্বপ্নে বিভোর হয়। এই পাহাড়ের কাছ ঘেষে মেঘের মেলা বসে। পাহাড়ের কোনো এক পাশে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়।

দূরের দেশের সুরমাখা মানুষেরা এখানে আসে, মুগ্ধ হয়। অগণিত পর্বত আরোহী পাহাড়ে উঠার বাসনায় মত্ত হয়। অনেক বরফ জড়ানো পাহাড় বেয়ে উড়তে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়। অনেক উঠতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছে। আবার যারা শীর্ষে উঠে যায় তাদের নিয়ে বিজয় উল্লাস করে দেশেবিদেশে। গত দু’বছর যাবৎ বড়বাবু এখানে আসে। পর্বতের শীর্ষে উঠার প্রশিক্ষণ নিতে থাকে।

এই পাহাড়ের শীর্ষে উঠা অতি সহজ নয়। এখানে আছে অগণিত প্রশিক্ষক। অনেকে সব শিখে ও শীর্ষে উঠতে পারেনি।

প্রিতুর আদরের ভাষা বুঝতে শিখেছে, এই ভেড়া। প্রতিদিন কাজের ফাঁকে প্রিতু আর ভেড়ার স্নেহচিত্র অনেকের চোখে পড়ে। অনেকটা মা ও মেয়ের মতো ভাব এদের।

প্রিতু ভেড়ার জন্য এমন ছোট ও চমৎকার গাড়ি তৈরি করে দেয়। তাতে চাপিয়ে দেয়া ফুলগুলি বয়ে নিয়ে যায়, সেই সোনার পাহাড়ের কাছে। বড়বাবুর প্রশিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষক ও সহকর্মীদের এই ফুল উপহার দেয়। তারা বেশ খুশি হয়। সকলে একে মালিনীর ভেড়া নামে চেনে।

ভেড়া মানব শিশুর মতো অদ্ভুত আকর্ষণে দূরের পাহাড়ে চোখ রাখে। কিভাবে মানুষেরা বরফের সীমানা বেয়ে উঠে, কিভাবে উঠতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে। দেখতেদেখতে ফিরে যাবার কথা ও ভুলে ভুলে যায়। এভাবে পড়ন্ত বিকেল পর্যন্ত ভেড়া ফিরে যাওয়ায় প্রিতু তাকে খুঁজতে আসে। দেখে, তার ভেড়াটি পর্বত আরোহীদের তাকিয়ে আছে অদ্ভুত ভঙ্গীতে। প্রিতু তার মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেয়। বলেকীরে, তোর কী সোনার পাহাড়ে উঠতে স্বপ্ন জাগে, ভেড়াটি ভ্যাএ করে তার সম্মতি প্রকাশ করে।

একদিন গাড়ি চেপে ফুল নিয়ে বড়বাবুর উদ্দেশ্যে রওনা দিলেও পথিমধ্যে কয়েকটি শিকারী কুকুরের তোপের মুখে পড়ে গেলো ভেড়া। কুকুরগুলি কোনো কারণ ছাড়া ভেড়াকে আক্রমণ করতে আসে। ভেড়া তার গাড়ি রেখে দ্রুত গতিতে ছুটতে থাকে। কুকুরগুলি এমনভাবে পিছু নেয় যে, ধরতে পারলেই কামড়ে ছিঁড়ে দেবে।

এভাবে ছুটতেছুটতে প্রিতুর কাছে এসে থামে। প্রিতু তার ভেড়াকে বাঁচাতে লাঠি নিয়ে এসে কুকুরগুলিকে তাড়িয়ে দেয়। এদিকে বেলা পড়ে আসে। বড়বাবু যথাসময়ে ফুল না পেয়ে নিশ্চয়ই ভীষণ চটে যাবে। সেদিনকার মতো প্রিতু ও ভেড়া মিলেই ফুলগুলি নিয়ে বড়বাবুর সামনে এসে দাঁড়ায়।

বড়বাবু পর্বত আরোহের প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে আসছিল। দেরী করে ফুল আনার কারণ প্রকাশ করলো প্রিতু। তবু অধিক রেগে একটি বেত উঁচিয়ে প্রিতু ও ভেড়াকে আঘাত করে। অতঃপর চাকরিচ্যুত করে।

সেই থেকে ফুলপুরে আর ফিরে যায়নি প্রিতু ও ভেড়া। বড়বাবুর গাছের ফুলেরা যত্নের অভাবে ঝরে পড়ে। বড়বাবু প্রিতু ও ভেড়াকে অনেক খুঁজেছে। কিন্তু দেখা পায়নি।

তারা দুজন মিলে পর্বত আরোহী প্রশিক্ষকের কাছে দেখা করল। প্রিতু তার ভেড়ার পর্বত আরোহের স্বপ্নের কথা প্রকাশ করে। প্রশিক্ষণ প্রথমদিকে অমত করলেও ভেড়ার গতি ও ই্‌েচছ দেখে সম্মতি প্রকাশ করেন।

প্রিতুর ভেড়া সবেগে বরফের পাহাড় বেয়ে উঠতে জানে। তৃষ্ণা পেলে বরফ খেতে জানে।

এক বিশেষ দিনের কথা। অগণিত পর্বত আরোহীল সাথে প্রিতুর ভেড়া অংশ নেয়। দীর্ঘ পাহাড় বেয়ে ভেড়া পৌঁছে গেছে শীর্ষে। দিকে দিকে জানা হলোমালিনীর ভেড়া সোনার পাহাড় জয় করে ফেলেছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুন সুখের ঘ্রাণ
পরবর্তী নিবন্ধকনসার্ট ফর বাংলাদেশ