‘অনন্ত আকাশ উঁচে / অনন্ত সাগর নিচে/ অনন্তে, অনন্তে দেখ করে আলিঙ্গন।’ জল ডুবুডুবু নীলের দেশ মালদ্বীপের ভূমিতে পা রাখতেই যা আমার সর্বপ্রথম মনে এলো তা হলো, গিরীন্দ্রনাথ দত্তের ‘সমুদ্রদর্শন’ কবিতার এই লাইনদুটো। মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার মতো তীব্র নীল জলরাশি স্বচক্ষে দেখার পাশাপাশি দারুণ রোমাঞ্চকর সমুদ্র তলদেশে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাইলে সমুদ্রপ্রেমীরা নির্দ্বিধায় ঘুরে আসতে পারেন মালদ্বীপ।
১২০০টি দ্বীপ আর ২৬ টি প্রবাল দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত অপার্থিব সব বিলাসিতার কেন্দ্রবিন্দু এই দ্বীপরাষ্ট্রটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড়ে মাত্র ১.০৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। অনএরাইভাল ভিসার সুযোগ নিয়ে প্রকৃতিপ্রেমীরা নিমিষেই মিটিয়ে নিতে পারেন তাদের সকল সমুদ্রতৃষ্ণা। যদিও সেদেশের ব্যয়বহুল পর্যটনখাত অনেকটাই রাশ টেনে ধরে সেই তৃষ্ণার।
মালদ্বীপ মূলত একটি দরিদ্র রাষ্ট্র। এদের নিজস্ব কোনো উৎপাদিত দ্রব্য নেই। নেই কোনো খনিজ সম্পদও। আমদানির উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল এই দেশের মানুষদের একমাত্র সম্পদ বা একমাত্র জীবিকা যাই বলা হোক না কেন তা হচ্ছে, সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ করা। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্য কোনো উপায় না থাকায় মালদ্বীপ তাদের দ্বীপগুলোকেই বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎসক্ষেত্র বানিয়েছে। মূলত এই দ্বীপগুলোরই হচ্ছে মালদ্বীপের সকল সৌন্দর্য্যের মূল আধার। তাদের একমাত্র সম্পদ। মোট ১২০০টি দ্বীপের মধ্যে ২০০টিকে তারা বিদেশিদের কাছে লীজ দিয়েছে। মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, জাপান, ইন্দোনেশিয়াসহ আরো কয়েকটা দেশ এই দ্বীপগুলো লীজ নিয়ে তার পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে পর্যটক আকর্ষণের জন্য সেগুলোকে স্বর্গভূমি বানিয়েছে। অবশ্য সেগুলোতে একরাত কাটাতে যে অংকের অর্থ খরচ করতে হয় তাও কিন্তু পিলে চমকানোর মতই! হাজার ডলারের কাছাকাছি প্রায়। আর আইল্যান্ড ভেদে এই অর্থ আরো অনেকটা বেড়ে যেতে পারে। সমপ্রতি নেদারল্যান্ড নাকি একটা দ্বীপ লীজ নিয়ে সেটাকে এমনভাবে তৈরি করছে যেটাতে একরাত কাটাতে পর্যটকদের গুনতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায় প্রায় ৮০,০০০ হাজারের কাছাকাছি। এবার দেশটির রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের দিকে কিছুটা আলোকপাত করা যাক।
আয়তন আর জনসংখ্যার দিক দিয়ে অত্যন্ত ছোট দেশ এই মালদ্বীপ। এর আয়তন মাত্র ২৫৮ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৫ লাখেরও নিচে। মালদ্বীপের রাষ্ট্রীয় ভাষা ‘দিভেহি‘। তবে ইংরেজি ভাষাটা মোটামুটি সবারই আয়ত্তে আছে। মালদ্বীপের মুদ্রার নাম রুফেয়া। (রূপাইয়া নয়)। ডলারের হিসেবে রুফেয়ার মূল্যমান বেশ ভালোই। ১ আমেরিকান ডলারে হয় ১৫ রুফেয়া। ‘মালদ্বীপ’ নামটি সম্ভবত ‘মালে দিভেহি’ রাজ্য থেকে উদ্ভূত। তবে দেশটির নামকরণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মতদ্বৈধতা আছে। কেউ কেউ মনে করেন, ‘মালদ্বীপ মানে ‘মেল দ্বীপ’। অর্থাৎ পুরুষদের রাজ্য। আবার শ্রীলঙ্কার প্রাচীন সাহিত্য ‘মহাবংশ’ অনুসারে মালদ্বীপ হচ্ছে ‘মহিলা দ্বীপ’। আবার অনেকের মতে, ‘দ্বীপ‘ যেহেতু একটা সংস্কৃত শব্দ তাই মালদ্বীপ নামটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘মালাদ্বীপ‘ থেকে। অর্থাৎ সমুদ্রের ঢেউমালায় সুশোভিত দ্বীপ। তবে অধিকাংশেরই মতে, মালদ্বীপ শব্দের উৎপত্তি ‘মালে দিভেই রাজে’এই নামটি থেকে। ‘মালে দিভেই রাজে’ শব্দের অর্থ হলো দ্বীপরাষ্ট্র। নামকরণের এই সর্বশেষ যুক্তিটাই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। দ্বাদশ শতক থেকে আজ অবধি মালদ্বীপে মুসলিম শাসন চলে আসছে। ১১৫৩– ১৯৫৩ পর্যন্ত এই ৮০০ বছর মোট ৯২ জন সুলতান নিরবচ্ছিন্নভাবে শাসন করে গেছেন এই দেশটিকে। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে সালতানাতের অবসান হয়। মালদ্বীপ হয়ে ওঠে রিপাবলিকান কান্ট্রি। প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন আমিন দিদি। উনিশ শতকে মালদ্বীপ হয়ে পড়ে ব্রিটিশ আশ্রিত। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালের জুলাই মাসে ব্রিটিশদের কাছ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে মালদ্বীপ। আগেই বলেছি, মালদ্বীপের আসল সৌন্দর্য তাদের সাজানো দ্বীপগুলো। ঘন নীল আর শ্যাওলাসবুজ ঢেউখেলানো ভারতমহাসাগরের বুকে অবিরাম দোল খেতে থাকা অনিন্দ্যসুন্দর এই ভূখণ্ডগুলোর দিকে তাকাতেই চোখে শান্তি আর সুখ যুগপৎ খেলা করে। কেমন জানি উড়ুক্কু হয়ে ওঠে মনটা। অস্থির হতে চায় মনের নানান সব অনুভূতি। ভালোলাগার মোড়কে আটকা পড়ে জীবনের শূন্য বা পূর্ণ সকল অমূল্য স্মৃতিগুলো। এখানে একদ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাবার জন্য আছে সাধারণ বোট, স্পীড বোট, সী ট্রাক, সী প্লেন সবই। কিছুক্ষণ পরপর সমুদ্রকে দু‘ ভাগ করে তীব্রবেগে ছুটছে স্পীডবোট। সমুদ্রের নীলজল ছুঁয়ে ছুঁয়ে কটেজগুলোতে নামছে সীপ্লেন। তবে মধ্যসমুদ্রের অবারিত নীলাকাশ আর নীল সমুদ্রের গলাগলির পাগলপারা রূপ দেখতে চাইলে সাধারণ বোটে একবার চড়তেই হবে সবাইকে !
একগলা জল মাড়িয়ে হেঁটে হেঁটে স্যান্ড আইল্যান্ডে যাওয়ার এমন মজা পর্যটকদের দিতে পারে শুধ এই বোটগুলোই।
ডলফিন কর্ণারে গিয়ে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী ডলফিনদের উড়ন্ত লাফ কিংবা মাথা উঁচু করে ভেসে থাকা, হাতের নাগালে এলে তাদের একটুখানি ছুঁয়ে দেওয়া এসব সৌন্দর্য দেখতে হলে সাধারণ এই বোটগুলোই ভালো। মালদ্বীপের ফাইভ স্টার প্রাইভেট রিসর্টগুলোতে গেলেই বোঝা যায়, উপভোগের প্রাচুর্য কাকে বলে? মালদ্বীপ মুসলিম প্রধান দেশ বলে এখানে পোশাকের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এসব প্রাইভেট আইল্যান্ডগুলোতে সেসবের বালাই নেই। মূলত পশ্চিমা পর্যটকদের কথা মাথায় রেখেই সাজানো হয়ে এই দ্বীপগুলোকে। এক একটা প্রাইভেট দ্বীপ যেন এক একটা স্বর্গীয় উদ্যান! ফুর্তি করতে চাইলে কী নেই এখানে? দুধসাদা বীচে বসে অবারিত পানাহার, কয়েকটা করে সুইমিং পুল, বিভিন্ন ওয়াটার এক্টিভিটি (স্নোরকেলিং, কায়াকিং, মিনি সাবমেরিন, প্যারাগ্লাইডিং ইত্যাদি, ইত্যাদি। রাতের বেলা রিসর্টগুলো থেকে সমুদ্রে তীব্র এক কৃত্রিম আলো ফেলে দেখানো হয় মানতারা নামের এক মাছের ঝাঁক। পাশাপাশি বিভিন্ন রকম মাছ, ছোট হাঙর তো আছেই যত্রতত্র তবে সবখানেই ঐ যে বললাম, ‘ফেলো কড়ি, মাখো তেল‘।
এখানকার সামুদ্রিক সৌন্দর্যের অমোঘ আধার হলো বীচগুলো। বীচের বালিগুলো ধবধবে সাদা হওয়ায় সূর্যের আলোয় ঝকমক করতে থাকে সেগুলো। এছাড়া রাতের বেলায় একধরনের জলজ পোকা (আমাদের জোনাক পোকার মতই) বীচের চারপাশে উড়ে বেড়ায় বলে রাতের বেলাতেও ঝকমক করতে থাকে বীচগুলো।
শুধু প্রাইভেট বীচগুলোতেই নয়, পাবলিক বীচগুলোতেও সৌন্দর্যের কমতি নেই। তফাৎ শুধু, প্রাইভেট দ্বীপগুলো হলো অবিমিশ্র উদ্দামতা আর উপভোগের, তেমনটা নয় পাবলিক দ্বীপগুলো। এখানে জনজীবন স্থির শান্ত। কিন্তু সমুদ্র তার সৌন্দর্য বিতরণে সবদিকেই সমান উদার। ‘হুলহুমালে’ নামের একতা পাবলিক দ্বীপ, যেটাকে সরকারিভাবেই কৃত্রিম উপায়ে সাজানো হয়েছে তার বীচে একটা বিকেল কাটালেই সেটাকে আপনি বানাতে পারেন আপনার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বিকেল। এখান থেকেই আপনি দেখবেন, সমুদ্রের অপর দিকে হুলেমালে এয়ারপোর্ট, পাশাপাশি প্লেন–জাহাজ –আকাশ– সাগর –মাটি সব একই ফ্রেমে। আর কী লাগে বলুন জীবনে? মালদ্বীপের রাজধানী মালে শহরটাকে লোকবসতিপূর্ণ অন্যান্য কয়েকটা দ্বীপ থেকে চায়না– মালদ্বীপ ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজের মাধ্যমে আলাদা করা হয়েছে। ছোট্ট অথচ কী সুশৃঙ্খল একটা শহর! কোথাও এতটুকু ময়লা নেই। যত্রতত্র কাগজ, চিপস আর বাদামের খোসা নেই। কোনো ট্রাফিকপুলিশ নেই এখানে অথচ সবাই কি নিয়ম মেনে চলছে! নিজেদের দেশের সাথে তুলনায় গেলে গোপনে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাসই বেরিয়ে আসে! এখানকার প্রায় পাঁচলক্ষ জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশই বাংলাদেশি। পুরুষ –মহিলা প্রায় সবাই বাইক বা স্কুটি চালায়। তবে হেলমেট কারো মাথায় দেখিনি। মালদ্বীপে প্রতিটি জিনিষের উপর সরকার নির্ধারিত ২৫% ট্যাঙ থাকে। এমনকি ছোট্ট একটা চকলেটের উপরেও। এখানে কেনাকাটার কিছুই নেই। চকলেট, চিপস, বিস্কুট সবকিছুই আমদানিকৃত বলেই জীবনযাত্রা এখানে অত্যন্ত ব্যয়বহুল! আর তেমন কিছু নেইও। এর চেয়ে অনেক ভালো সব আমাদের দেশেই আছে। সমুদ্রকন্যা মালদ্বীপকে নিয়ে সুপরিসর আলোচনার শেষটা টানি এভাবে, পর্যাপ্ত টাকা আর সময় নিয়ে মালদ্বীপে না এলে এখান থেকে আপনাকে ফিরতে হবে শুধু আফসোস আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে!
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার