বিশ্ববাসী সম্যক অবগত আছেন, গত ৭ অক্টোবর ২০২৩ ফিলিস্তিনের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে দীর্ঘকাল ধরে পরিচালিত যুদ্ধের অংশ হিসেবে হামাসের ইসরাইল আক্রমণকে কেন্দ্র করে ইসরাইলের পক্ষ থেকে গাজা ও পশ্চিম তীরে অবিরাম বিমান–স্থল হামলায় নৃশংসতম হত্যা–গণহত্যার দৃশ্যাদৃশ্য ভয়ঙ্কররূপ পরিগ্রহ করেছে। বিশ্বের কতিপয় ক্ষমতাধর কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রনায়কের প্রত্যক্ষ মদদ ও আধুনিক সামরিক সহযোগিতা অব্যাহত রেখে নারকীয় তান্ডবের নজিরবিহীন দৃশ্যপট তৈরি করে চলছে। সমগ্র ধরিত্রীর সভ্যসমাজ অবাক বিস্ময়ে এহেন বর্বর কর্মযজ্ঞ শুধু পর্যবেক্ষণ করছে না; তীব্র ঘৃণা ও নিন্দার সাথে ইসরাইলি কদর্য অপকৌশল প্রত্যাখান করছে। ইসরাইলকে সরকার প্রধানদের সমর্থন স্ব স্ব দেশে সাধারণ জনগণ কর্তৃক জঘন্য ঘৃণার চোখে দেখা হচ্ছে। গণমাধ্যম সূত্রমতে, জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিশ্বের সকল বিবেকবান মানুষ যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব গ্রহণ ও বাস্তবায়নে পক্ষাবলম্বন করা সত্ত্বেও, মার্কিন সরকারের একপেশে নীতিতে তা নস্যাৎ হতে চলেছে। তথাকথিত মানবাধিকার সুরক্ষার সবক প্রদানকারীদের কঠিন হৃদয় এত বিশাল সংখ্যক শিশু–কিশোর–নারী হত্যায় মোটেও বিচলিত হচ্ছে না; বরং যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে পুরো ফিলিস্তিনকে পরিপূর্ণ ধ্বংসের হীন উদ্যোগ অতিশয় দৃশ্যমান। এই নারকীয় তান্ডবের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর সাথে সমস্বরে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নানামুখী প্রতিবাদ–নিন্দা–ঘৃণা প্রকাশে প্রবল সোচ্চার।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান বন্ধের আদেশ চাওয়ার প্রেক্ষিতে ২৬ জানুয়ারি গাজার যুদ্ধে গণহত্যার মতো অপরাধ ঠেকাতে এবং বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের সহায়তা দিতে ইসরায়েলকে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ১৭ জন বিচারকের প্যানেলের প্রায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেওয়া আদেশে বলা হয়, ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা, তাদের মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করা, গাজায় বসবাসের অযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করা কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিদের জন্মগ্রহণে বাধা দেওয়া এড়িয়ে চলতে সম্ভাব্য সবকিছুই করতে হবে। আদালত আরও জানায়, জনগণকে গণহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া ঠেকানো এবং প্ররোচনা দেওয়ার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করতে ইসরায়েলের আরও বেশিকিছু করা উচিত। গাজা অভিযানে ইসরায়েলের বাহিনী যাতে গণহত্যার মত কিছু না ঘটায়, দেশটিকে তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া আদালত গাজায় মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলায় ‘তাৎক্ষণিক ও কার্যকর ব্যবস্থা’ নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছে এবং এই আদেশ বাস্তবায়নে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এক মাসের মধ্যে ইসরায়েলকে তা প্রতিবেদন আকারে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, একদিকে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান বন্ধের প্রত্যাশিত আদেশ অবজ্ঞা করা হয়েছে এবং অন্যদিকে যুদ্ধবিরতির আহ্বানও জানায়নি জাতিসংঘের এ সর্বোচ্চ আদালত। যদিও দক্ষিণ অফ্রিকার আনা গণহত্যার অভিযোগ খারিজের ইসরায়েলি আবেদনে সাড়া দেয়নি আইসিজে। ফিলিস্তিনিদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলার জন্য হামাসকে দায়ী করে ইসরায়েল বরাবরই গণহত্যার অভিযোগ জোরালোভাবে অস্বীকার করছে। প্রাসঙ্গিকতায় উক্ত আদালতের প্রধান বিচারক বলেন, ‘জেনোসাইড কনভেনশন অনুযায়ী যেকোনো রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আইসিজেতে আসতে পারে। গাজা পরিস্থিতি নিয়ে এ আদালতে মামলা করার এখতিয়ার দক্ষিণ আফ্রিকার রয়েছে এবং তা আমলে নেওয়ার বিচারিক ক্ষমতাও ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের রয়েছে। গণহত্যার মূল অভিযোগের বিষয়ে আইসিজের সিদ্ধান্ত পেতে আরও অনেক শুনানি প্রয়োজন হবে।’ বিশ্লেষকদের অভিমত, যদিও গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে এটিই আদালতের চূড়ান্ত রায় নয়। কিন্তু আদালত যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, সেগুলো মূলত গাজায় ফিলিস্তিনিদের কিছু সুরক্ষার ব্যবস্থা করার কথা ভেবেই করা হয়েছে। বিচারকরা একইসঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার মূল অভিযোগও বিবেচনায় নিয়েছেন। এখন ইসরায়েল এ রায়ে কীভাবে সাড়া দিবে সে ব্যাপারে তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আইসিজে এর আদেশ মেনে চলার আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু সেটি কার্যকর করার কোনো ক্ষমতা আদালতের নেই। ইসরায়েল চাইলে বিচারকদের আদেশ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে পারে।
এটি সুস্পষ্ট যে, গাজায় নারকীয় তান্ডবের বিরুদ্ধে পুরোবিশ্ব ঐক্যবদ্ধ। জাতিসংঘের মানবিক যুদ্ধবিরতিসহ পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশেই প্রতিদিনই বিশাল জনসমাবেশ–র্যালির মাধ্যমে ইসরাইল ও সহযোগী কর্তৃত্ববাদীদের নির্মূলে জোরালো উচ্চারণ ধ্বনিত–প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। উত্তাল তরঙ্গের মত প্রত্যেক সাগর–মহাসাগরীয় দেশসমূহে আপামর নাগরিকবৃন্দের মনোবেদনায় পুরো ধরিত্রী গভীর আর্তনাদে বিষাদগ্রস্ত। নির্মোহ–নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে এটুকু দাবি করা মোটেও অমূলক হবে না যে, কথিত গণতন্ত্র–মানবাধিকার সুরক্ষায় সবক দেওয়া দেশগুলোর হিংস্র পশুতুল্য আচরণ পরিপূর্ণভাবে বিশ্বের সকল সভ্য নাগরিক কর্তৃক প্রত্যাখিত। গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধের দাবিতে পুরো ইউরোপজুড়ে হাজার হাজার মানুষের পদযাত্রা–বিক্ষোভ–সমাবেশ পরিলক্ষিত। ‘স্টপ দ্য জেনোসাইড ইন গাজা’, ‘সিজফায়ার’, ‘এন্ড টু দ্য সিজ অব গাজা’ স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভকারীরা গাজা যুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের কার্যক্রমের নিন্দা জ্ঞাপন করে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের অস্থায়ী রায় সত্ত্বেও যুদ্ধ আইন ও বিশ্বমানবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনে ইসরাইল গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীরে বিরল গণহত্যা অব্যাহত রেখেছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস শহর সংঘাতের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। শহরটিকে ঘিরে ইসরায়েলি যুদ্ধ বিমান ও গোলন্দাজ বাহিনী ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ গণমাধ্যমে প্রকাশিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বিবৃতির তথ্যমতে, গত ৬ ফেব্রুয়ারি গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনী পরিচালিত ১২টি গণহত্যায় ১০৭ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১৪৩ জন আহত হয়েছে। এ নিয়ে ৭ অক্টোবর থেকে হাসপাতালে আনা হয়েছে এমন মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৫৮৫ জনে। তন্মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ নারী ও শিশু। এছাড়া আহত হয়েছে প্রায় ৬৭ হাজার ফিলিস্তিনি। অনেক মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছে। সম্প্রতি ‘নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে ঘোষিত রাফাহ শহরে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর আক্রমণের হুমকিতে সেখানে আশ্রিত লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
ইসরায়েলের চলমান অমানবিক এই হামলায় প্রায় ৬০ শতাংশ আবাসিক ভবন–স্কুল–মসজিদ–গির্জা–শরণার্থী শিবির–হাসপাতাল ধ্বংস হয়েছে। জাতিসংঘের মতে, ইসরায়েলের বর্বর হামলায় গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত। বিগত চার মাস ধরে ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক তান্ডবে গাজা ‘বসবাসের আযোগ্য’ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। খাদ্য–বিশুদ্ধ পানি–জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র মানবিক সংকটের মধ্যে গাজাবাসীরা সকলেই নিরাপত্তাহীন অবস্থার মধ্যে রয়েছে। হাজার হাজার মানুষ কোনো ধরনের আশ্রয় ছাড়াই বসবাস করছে। অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে মানুষ ঘাস ও দূষিত পানি পান খাচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের মতে, গাজায় দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থার (ইউনিসেফ) ধারণা গাজায় হামলায় অন্তত ১৭ হাজার শিশু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দখলকৃত ফিলিস্তিন ভূখন্ডে নিয়োজিত ইউনিসেফের যোগাযোগ বিষয়ক প্রধান আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বলেন, ‘গাজার প্রায় সব শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রয়োজন। প্রতিটি শিশুর ক্ষতি ও শোকের হৃদয়বিদারক গল্প রয়েছে। ১৭ হাজার সংখ্যাটি একটি অনুমান, কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে তথ্য যাচাই করা প্রায় অসম্ভব। পরিবারহারা অনেক শিশু তাদের নাম বলতেও পারে না। তারা একটি ভয়ংকর নতুন বাস্তবতার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে।’
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের টানা হামলা বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতের হুমকি তৈরি করছে বলে সতর্ক করেছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুলরহমান বিন জসিম আল থানি। যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ইসরায়েল–হামাস সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়ে কাতারের ভূমিকা নিয়ে মার্কিন গণমাধ্যম এনপিআরে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধ থামানোর জন্য আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। আমাদের নারী, শিশুসহ সেই জীবনগুলো রক্ষা করতে হবে যারা বিমান হামলা, ট্যাংকের গোলা, বোমাবর্ষণসহ সব কিছুর কারণে তাড়া খেয়ে পালাচ্ছে, মরছে।’ সাম্প্রতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনায় দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধের দামামা বাজছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হঠাৎ হামাস–ইসরায়েল সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও সমরণীতিতে বৈশ্বিক খেলোয়াড়দের অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়ে ক্রমেই বড় যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের ক্রমবর্ধমান সংঘাতে ইসরায়েলসহ জর্ডান, ইরান, সিরিয়া, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইরাক, লেবানন ও ইয়েমেন কমবেশি জড়িয়ে পড়েছে।
অতিসম্প্রতি সিরিয়ার সীমান্তঘেঁষা জর্ডানে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলায় তিন সেনা নিহত হওয়ার প্রতিশোধ নিতে ২ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ইরাক ও সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের বিভিন্ন স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড জানায়, দেশটির বাহিনী ৮৫টি লক্ষ্যবস্তুতে আইআরজিসির অভিজাত কুদস ফোর্স ও সংশ্লিষ্ট মিলিশিয়াদের ওপর হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিমান থেকে ইরান সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর ওপর ১২৫টির বেশি দূর নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র ছোড়া হয়েছে। এমন হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল কমান্ড ও গোয়েন্দা–রকেট–ক্ষেপণাস্ত্র–ড্রোন কেন্দ্র এবং আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম–অস্ত্র সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত স্থাপনাগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের হামলায় ইরান ও তার সমর্থক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো পাল্টা জবাবের ওপর যুদ্ধের মাত্রা নির্ভর করলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন যুদ্ধ শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়; পুরো বিশ্বব্যবস্থায় ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনার সমূহসম্ভাবনাও অধিকতর উচ্চকিত।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।