মারি নিয়ে ঘর করার বছর পূর্ণ করতে চলেছে পৃথিবী। ২০২০ সাল জুড়ে নির্বিঘ্নে রাজত্ব করেছে কোভিড-১৯। এক অবিশ্বাস্য জীবনযাত্রা, দুর্বিষহ পথচলা। আশার বাণী কানে আসতে না আসতেই ঘিরে ধরছে নিরাশার অন্ধকার। তাই বলে থেমে নেই জীবনধারা। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীর প্রতিটি সদস্য কোন না কোনভাবে আক্রান্ত, প্রভাবিত। তবে প্রাকৃতিক, অ-প্রাকৃতিক কিংবা অতি-প্রাকৃতিক যে কোন দুর্যোগের মতো কোভিডকালের ঝড়ঝাপটার অনেকটাই বয়ে যাচ্ছে নারীজাতির ওপর দিয়ে, যদিও প্রত্যক্ষভাবে অণুজীবের ছোবলে মৃতের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে মনে হতে পারে কোভিড বুঝি করুণাই করছে মেয়েদের ওপর। করোনাকালে বিশ্বজুড়ে ষাট শতাংশ পুরুষের বিপরীতে মৃত নারীর সূচক চল্লিশ শতাংশ। তবে কি মেয়েদের অবস্থা ও জীবনযাত্রার মানের অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে? খাদ্য, পুষ্টি ও যত্নের ছোঁয়া পেতে শুরু করেছে জগতের মাতা, কন্যা, ভগ্নী ও স্ত্রীগণ?
কোভিডের আগমনে হঠাৎ থমকে যাওয়া পৃথিবীতে ঘরে ঢোকার ডাক এলে সকল গৃহবাসী সপ্তাহের সাতদিন চব্বিশ ঘণ্টাই ঘরে থাকতে শুরু করে। আধুনিককাল কেবল নয়, পৃথিবীর জন্মাবধি এমন দিন এমন সময় কোনকালে আসেনি। পারিবারিক জীবনধারায় রাতদিনের হিসেব নিকেশ ভুলে একছাদের নিচে সকলে মিলে- অনেক ভালোবাসায় মাখামাখি নির্ভার একটা শান্তির হাওয়া বয়ে যাওয়ার কথা ছিল ঘরে ঘরে। কিন্তু সেটা বোধকরি খুব স্বল্প সংখ্যক গৃহবাসীর ভাগ্যেই ঘটেছে। পারিবারিক সহিংসতা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে, দেশে দেশে সমগ্র পৃথিবীতে। সহিংসতার শিকার কে বা কারা, তা নতুন করে বলে দেওয়ার কিছু নয়। একটা পরিবারের সুরক্ষায় যিনি বা যারা সবচেয়ে বেশী খেটে মরেন, কেঁদে মরেন নিয়তির খেয়ালে যাবতীয় যন্ত্রণা দুর্ভোগের ভারও তাঁদেরকেই বয়ে যেতে হয়। নারীর সামজিক অবস্থানের সেই চিরাচরিত চিত্র। অতিমারিকালে তার ব্যত্যয় হয়নি কোথাও।
সম্মুখসারির যোদ্ধাই হন আর গৃহ ব্যবস্থাপক, নারীর ঘড়ির কাঁটায় বিরতি কিংবা আয়েশের অবকাশ নেই। জীবন সঙ্গীর অনাস্থা ও অসহযোগিতায় ছকে বাধা জীবনটাকে নিয়ে নতুন ভাবনায় পড়ে যান অনেক নারী। প্রজ্ঞাবান গৃহকর্তাদের কেউ কেউ হাত লাগান হেঁসেলে। তা নিয়ে রম্য রচনার জোয়ার বয়ে যায় সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। গৃহকর্মে হাত লাগিয়ে গিন্নীকে যেন উদ্ধার কিংবা করুণাই করেন উদারমনা কর্তাগণ! অনেকের কাছে আবার তা পদস্খলনের মতো; আপিসের বড় কর্তা থালা বাসন মাজেন- অতিমারির কালে এমন দুর্দিনও এসেছে পুরুষের কপালে! গৃহ ব্যবস্থাপনা বিষয়টা যে একান্তই মেয়েলী নয়- একুশ শতকের শিক্ষিত নাগরিকদের মাঝে সে বার্তা পৌঁছেনি। আগামী শতকে পৌঁছুবে সে আশা করার মতো কোন আলোর রেখা দৃশ্যমান নয়।
উপরন্তু সর্বক্ষণ গৃহে অবস্থানরত কর্তার মনোরঞ্জনের জন্য গৃহিণীদের সাজসজ্জার টিপস বাতলে দেয়, নানা গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়ে ধন্য হয় মুফতে এমন অনেক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আত্মপ্রকাশ করেছে অন্তর্জালে। সমপ্রতি জাতীয় দৈনিকে বড় করে ছাপা হয়েছে চোখ সাজানোর তরীকা। অণুজীবের আক্রমণের আশংকায় মুখোশে ঢাকা নাক মুখ। ঠোঁট ও গাল রাঙালে সৌন্দর্য প্রদর্শনের উপায় নেই। তাই অনাবৃত চোখজোড়াই একমাত্র হাতিয়ার। সত্যিই, জীবন সাজাতে আয়োজনের শেষ নেই আমাদের, অথচ জীবন বাঁচাতে কি করছি! (স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে কথা বলে হাসির খোরাক হওয়ার বাসনা আর নেই।) মুখে মুখে নারীবাদের ফেনা তুলে কার্যত প্রতিনয়ত সেবাদাসীর ভূমিকায় নামানো হয় নারীকে। নারীরাও উদ্বাহু বাড়িয়ে সেইসব জ্ঞান অর্জন করেন, উদয়াস্ত খাটাখাটুনীর পর নিজেদেরকে ঘষেমেজে তৈরি করেন। এত কাঠখড় পুড়িয়েও শেষ রক্ষা হয়না অনেকের। ঘর ভাঙার খবর আসে প্রতিদিন। পর্দার তারকা হতে সাধারণ নাগরিকদের অনেকের জীবনেই ঘটে যায় ছন্দপতন। কে জানে হয়তো- ছন্দ ফিরেই আসে। একালের রঙচঙ মাখা সুখি সুখি গৃহস্থালিতে আসল নকলের খোঁজ পাওয়া সাধারণের কাজ নয়।
যারা আজও রঙচঙ মাখতে শেখেনি, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আজও যাদের দুয়ারে কড়া নাড়তে পারেনি, সেইসব নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত কিংবা প্রান্তিক নারীদের জীবনযুদ্ধেও নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে কোভিড- সিআরবি বাংলোয় ৪৫ বছর বয়সী নারীর লাশ। করোনা উপসর্গ নয়, উপসর্গ দেখে ধারণা করা হয় পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড এবং সম্ভাব্য হত্যাকারী তার সন্তানের বাবা, যাকে আমাদের সমাজ স্বামী উপাধি দিয়ে প্রভুর আসনে বসিয়ে দিয়েছে। বাঁশখালীর সাধনপুরের বাইশ বছর বয়সী পোশাক কর্মী সেলিনা আকতার শেলি’র লাশ পাওয়া যায় আনোয়ারা’র উপজেলা হাসপাতালে ফটকের কাছে। বিয়ে হয়েছিল দুহাজার ঊনিশের পয়লা জুনে। দুহাজার বিশের চব্বিশ জুন তার মৃতদেহের ছবি খবরের কাগজে। দেখে মনে হয় পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। শেলির বাইশ বছর জীবনের ইতিহাস খুঁড়তে যাব সে সময় আমাদের কোথায়? দরকারইবা কী? স্বামী কিংবা পরিবারের সদস্যদের হাতে নারীর মৃত্যু প্রতিদিনই দেশের নানা জনপদ হতে খবর আসছে। ব্রাকের পরিসংখ্যান বলছে এ-বছর নারীর প্রতি সহিংসতার হার গেল বছরের তুলনায় সত্তর শতাংশ বেশি। আইনের সহায়তা চাইতে গিয়েও নতুন করে নিগ্রহের শিকার হয় নারী। ধর্ষণের মহোৎসব চলছে বছর জুড়ে। অক্টোবরে গণমাধ্যম থেকে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে রাজপথে। জনদাবীর মুখে আইনসভায় প্রণীত হয় নতুন আইন। অপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার বিধান করা হয়। অপরদিকে আদালত প্রাঙ্গণে কিংবা কারা ফটকে মিষ্টিমুখ করে ধর্ষকের বিয়ে সেই কালজয়ী আইনের অন্তঃসারশূন্যতার সাক্ষ্য বহন করে। মানবাধিকার কমিশন বলে এক সার্বভৌম সংস্থা আছে আমাদের দেশে যারা জেগে জেগে ঘুমায় বলে প্রতিবেদন দিয়েছেন হাইকোর্ট।
আশার কথা সৌদি আদালত আবিরন হত্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আমাদের বিজয় দিবসেই প্রথম শুনানি হয়েছে। আবিরনের কথা হয়তো আমাদের অনেকে ভুলেই গিয়েছে। ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর মরুর বুকের মৃত্যু উপত্যকা থেকে চকচকে কফিনে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিল আবিরন। আবিরন অবশ্য একা নয়, এরকম অসংখ্য কফিনে চড়ে অনেকগুলো নিথর দেহের নারী ও কিশোরী ফিরে এসেছিল বছর জুড়ে।
এ বছর কত লক্ষ মেয়েকে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ায় ইস্তফা দিয়ে আদর্শ বধূ হবার শপথ নিতে হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা জরুরি। করোনাকালে ধুম পড়েছে বাল্যবিবাহের। জীবনের চরম অনিশ্চয়তার মুখে মেয়ে পুষে অর্থনাশ করার কোন মানে হয় না। তাছাড়া চারদিকে থাবা বিস্তার করে থাকা সহস্র শকুনের দলের হাত থেকে কিশোরী কন্যাদের বাঁচাতে দরিদ্র পিতামাতাদের কিইবা করার আছে! সত্যিই কি এভাবে বাঁচানো যায় ওদের? অবশ্য লেখাপড়া করেই যে আমাদের সব মেয়েরা (ছেলেরাও) পরিবার তথা দেশজাতির মুখ উজ্জ্বল করে চলেছে, তাতো নয়। বিজয়ের মাস শেষ হবার দিন সাতেক আগে নতুন খবর আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের নিয়ে। রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত বাকবিতণ্ডার সূত্র ধরে মধ্যরাতে (একেতো মাহামারি তার ওপর শীতের রাত) ডেকে নিয়ে আচ্ছা করে শাসন করা হয় নিয়ম ভাঙা কর্মীকে। উদ্ধত আচরণের জন্য কিল ঘুষি লাথি’র পর নিউইয়র্কের সেই সাদা পুলিশের কায়দায় আক্রান্তকে হাঁটু চাপা দেয়ার চেষ্টাও করা হয়। দুজন পুরুষ সমর্থক এগিয়ে আসে আক্রমণকারী নারী নেতাদের সমর্থনে। শেষ দৃশ্যে আইনের প্রবেশ। প্রাণে বেঁচে যায় ভুক্তভোগী ছাত্রী। এরই নাম যদি হয় নারীর ক্ষমতায়ন, তবে বেগম রোকেয়ার জীবন ও সংগ্রামের যাবতীয় স্মারককে মাটিচাপা দিয়ে রাখলেই হয়। ঘটা করে রোকেয়া দিবস পালনের কোন অর্থ হয় না।
২০২০ সালে নারীর অর্জন নিয়ে লিখতে বসেছিলাম। মারিকালেও প্রাপ্তির খাতা একেবারে শূন্য নয় সত্য (অনেকেই লিখছেন প্রাপ্তির কথা), তবে বঙ্গনারীর দুর্ভোগের ফিরিস্তি শেষ হবার নয়। সকল দুর্ভোগের জন্যই দায়ী কেবল পুরুষ নয়। শিক্ষিত, আধুনিক ও ধনী নারীরা যখন ঘরে বাইরে নিগৃহীত হয়, তখনতো অশিক্ষা কুসংস্কার আর দারিদ্রকেও দোষারোপ করা চলে না। সুন্দর আগামীর জন্য, নারীবান্ধব নিরাপদ সমাজের জন্য মেয়েদের নিজেকে সম্মান করা শিখতে হবে। ভারী ভারী সনদ লাভ করে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়া নয়, মঞ্চ কিংবা সভা-সমিতির সৌন্দর্য বৃদ্ধি নয়, বরং প্রতিভা ও কর্মোদ্দীপনা দিয়ে সমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করতে হবে। আমাদেরকে শিক্ষার প্রকৃত শক্তি, দর্শন ও সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে হবে।