মান্দালের মরুদ্যান পোপা পর্বতে- ২

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:১০ পূর্বাহ্ণ

প্রায় ৫০ কিলোমিটার জার্নি করে এসে কয়েক মাইল হেঁটে ৭৭৭ টি সিঁড়ি বেয়ে উঠে পোপা পর্বতের টাউং কালাত এর নাত মন্দির দেখে আমার ঠিক মন ভরলো না। নামার পথে সিঁড়ির পাশে পর্যটকদের জন্য বেশ কিছু দোকান সাজানো আছে। ছোট ছোট রঙিন মাটির নাতের মূর্তি বিক্রি করছে এক দোকানি, আরেকজন জামাকাপড় নিয়ে বসেছে, আছে বার্মার ঐতিহ্যবাহী হ্যান্ডলুমের ঝোলা ব্যাগের দোকান। আমার চোখ আটকে গেল তাল পাতার তৈরি জিনিসের একটা দোকানে। বাংলাদেশে আমরা তালপাতার পাখা, তালপাতার সেপাই দেখেছি, আবার ঢাকা শহরের ট্র্যাফিক জ্যামে কচি তালপাতার তৈরি ঘর সাজানোর ফুলও দেখেছি, কিন্তু এসবের বাইরে আর খুব বেশি কিছু দেখিনি। এই দোকানে তাল পাতা দিয়ে তৈরি গহনার পসরা বসেছে। চুলের ক্লিপ, হাতের চুরি, গলার মালা কি নেই! আর এই সব গহনার নান্দনিকতার কথা নাইবা বললাম। চোখ জুড়িয়ে গেল। আমি কিছু জিনিস কিনে নিলাম। ছোটখাট জিনিসগুলো উপহার হিসেবে বেশ হবে। ঝোলা ব্যাগ থেকেও চোখ সরাতে পারছি না। মিকা স্থানীয় একধরনের প্যান্ট দেখছে কেনার জন্য। মন্দির দেখে যে আশাভঙ্গ হয়েছিল, সেটা কেনাকাটা করে যেন আমরা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলাম। পাহাড় থেকে নেমে এসে ভীষণ ক্ষুধার্ত আমরা খাবারের দোকানের সন্ধান করতে লাগলাম। রাস্তার উপর বেঞ্চে বসে লোকজনকে নুডুলস খেতে দেখে আমরাও বসে পড়লাম। খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম রাস্তার উলটো পাশে একটা পুরানো দালানের সামনে বেশ ভিড় জমেছে। সেখান থেকে আবার ফোক গান-বাজনার সুর ভেসে আসছে। খাবার শেষে আমিও ভিড়ের একজন হয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম কি চলছে ভেতরে। ভিড় ঠেলে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছি দেখে আমাকে পথ ছেড়ে ভেতরে যেতে দিল দর্শকেরা। মিকার হাত টেনে নিয়ে হাজির হলাম ঘটনার কেন্দ্রে। ওমা! দেখি গানবাজনার আসর বসেছে। ভাষা না বুঝলেও, বাদ্যযন্ত্র আর কথার সুর মগজে সিগন্যাল পাঠাতে লাগলো, কিছুক্ষণ না শুনলে আফসোস করতে হবে পরে।
রাস্তার পাশের একটা দালানের নিচতলা। দুই পাশে দেয়াল দেয়া, দুইপাশ খোলা একটা রুম। অনেকটা মসজিদ বা মন্দিরের খোলা জায়গার মত যেখানে মানুষ এসে বসে। রুমের ভেতরে একপাশের দেয়ালের সামনে শিল্পীরা বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে, আর একজন দুইজন নারী গান করছে। অনেক নারীপুরুষ শিশু রুমের ভেতরেই বসে দেখছে এবং শুনছে। ঠিক যেন আমাদের বাউল গানের আসরের মত। আমি আর মিকাও গিয়ে বসলাম। ভালো করে খেয়াল করলাম যে দু’জন নারী গান করছে তারা আসলে রূপান্তরিত নারী (ট্রান্স উইম্যান), যাকে বাংলাদেশে আমরা হিজড়া বলে ডাকি। একজন গায়িকার এক হাতে সিগেরেট, আরেক হাতে একটা পানীয় সমেত কাঁচের গ্লাস। তাদের পাশেই একটা টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা ফুল, সাথে মোম আর আগরবাতি। দেখে উপাসনার স্থান মনে হল। আশেপাশের মানুষের মাঝে হিজড়াদের নিয়ে আতঙ্ক আর নেতিবাচক ভাবনা দেখে দেখে বড় হয়েছি। আর সেখানে ঠাকুরের সামনে একটা হিজড়া মেয়ে সিগেরেট-মদ খেতে খেতে নেচে নেচে গান করছে, এ আমার সনাতনী ভাবনায় কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। জানতে পারলাম, এটি একটি বিশেষ অনুষ্ঠান যেখানে নাতদের উপাসনা করা হয় এবং এই নাচ-গান উপাসনারই অংশ। আর হিজড়া এখানে অনেকটা ওঝার ভূমিকা রাখছে। এদের বলা হয় নাত কাদাও মানে আত্মার স্ত্রী। স্থানীয়দের বিশ্বাস, রূপান্তরিত নারী উপাসনা করলে নাত তার উপর ভর করবে, আর মানুষের নানাবিধ প্রার্থনা মঞ্জুর করবে। তবে এক এক নাত এক একটি বিষয়ের প্রার্থনা মঞ্জুর করতে পারে। এই যে সিগেরেট আর মদ খেয়ে নেচে-গেয়ে যে নাতের উপাসনা করা হচ্ছে, সেই নাতের নাম মিন ক্যাওয্‌বা। সে হাজার বছর আগে, নাত হবার আগে মিন ক্যাওয্‌বা ছিল একজন বড়লোকের বখে যাওয়া পাঁড় মাতাল, মেয়েবাজ, নষ্ট ছেলে। তার বাবা কি করতেন সেটা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কেউ বলে পাগান রাজ্যের রাজা ছিল, কেউ বলে সেনাপতি ছিল। সে যাই হোক, মোদ্দা কথা হল মিন ক্যাওয্‌বা বাপের ধন সম্পদ ভোগ করে বিলাসবহুল স্বেচ্ছাচারী জীবন কাটিয়েছে, তবে তার মৃত্যু হয়েছে অপঘাতে। অপঘাতে মৃত্যু না হলে তো আর নাত হওয়া যায় না। তো, যে সব মানুষ জীবনে কষ্ট না করে, মিন ক্যাওয্‌বার মত জীবন কাটাতে চায়, তারাই তার উপাসনা করে। আমরা যে উপাসনা দেখছি সেটা তারই উপাসনা, এই অনুষ্ঠানের নাম নাত প্যে। মজাই পেলাম! আহা এমন জীবন পেলে নেহায়েত মন্দ হত না!

মজার ব্যাপার হল, বাংলাদেশে যেমন হিজড়াদের রাষ্ট্র স্বীকার করে নিয়েছে, বার্মায় কিন্তু দেয়নি। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, বাংলাদেশে হিজড়া মানে যখন পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হয়, কিন্তু, ট্রান্সজেন্ডার কেবল নারীতে রূপান্তর বুঝায় না, নারী থেকে পুরুষে রূপান্তরও এর অন্তর্ভুক্ত। তবে, পুরুষের নারীতে রূপান্তর যতখানি গ্রহণ করে নিয়েছে বাংলাদেশের সমাজ, নারী থেকে পুরুষে রূপান্তর সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ আরেক রাজনীতি, সে না হয় আজকে থাক। বার্মায় জন্মগত যৌন পরিচয় পরিবর্তন আইনত দন্ডনীয়। ট্রান্সজেন্ডার মানুষকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হতে হয়। ব্রিটিশদের করা সান্ধ্য আইন এখনও কম-বেশি ব্যবহার করা তাদের ঔপনিবেশিক এই অঞ্চলের দেশগুলোতে। বার্মাতেও সূর্যাস্তের পর সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডের জন্য পুলিশ মানুষকে গ্রেফতার করতে পারে, এবং এই আইনের বেশি প্রয়োগ হয় ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের হয়রানি করবার জন্য। সামাজিকভাবে ট্রান্সজেন্ডার মানুষ অগ্রহণযোগ্য। আর সেইসব ট্রান্সজেন্ডার মানুষের উপর ভর করে নাত পূরণ করে আপামর মানুষের প্রার্থনা!
এখনও বাংলাদেশে কন্যা সন্তানের জন্ম সব পরিবারে ভালভাবে নেয়া হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কন্যা সন্তান জন্মানোর সকল দায় বর্তায় স্ত্রীর উপর। জীববিজ্ঞান বইয়ের যখন প্রথম মেন্ডেলের সূত্র পড়ে জেনেছিলাম, একজন মানুষ নারী হবে না পুরুষ হবে তা নির্ভও করে পুরুষের উপর, তখন দুনিয়াসুদ্ধ মানুষের মাথায় ব্যাপারটা ঠুকে ঠুকে ঢুকিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল। তারপর বড় হবার পর ট্রান্সজেন্ডার মানুষকে দেখে প্রশ্ন এল, মানুষের শরীরে XX ক্রোমোজোমের জন্য যদি নারী হয়, আর XY এর জন্য পুরুষ হয়, তাহলে ট্রান্সজেন্ডার হয় কীভাবে? কৌতূহল মেটাতে ঘাঁটাঘাঁটি করে জেনেছি, মানুষের শরীরে কেবল XX ক্রোমোজোম থাকলেও, তার ব্রেইনের গঠন হতে পারে পুরুষের মত, আবার XY ক্রোমোজোম থাকার পরেও ব্রেইনের গঠন হতে পারে মেয়েদের মত। প্রথম যখন আমি জেনেছিলাম যে, নারী আর পুরুষের মগজের গঠন আলাদা, খুবই চমৎকৃত হয়েছিলাম। আরও চমৎকৃত হয়েছিলাম জেনে যে, মায়ের পেটে থাকার সময় ৫-৭ সপ্তাহের মধ্যে মানুষের যৌনাঙ্গ গঠিত হয়, সেই সময় শরীরে SRY জিনের উপস্থিতি ঠিক করে দেয় শিশুর যৌনাঙ্গ কি নারীর হবে না পুরুষের হবে। যার ফলে কোন কোন মানুষের শরীর নারীর হলেও, তার ক্রোমোজোম হতে পারে XY, মানে শরীরের ভেতর পুরুষের জিন নিয়েও বাইরে সে নারী হতে পারে। একই ভাবে শরীরের ভেতর নারীর জিন নিয়েও বাইরে পুরুষ হতে পারে। আর গর্ভের শিশুর ব্রেইন নারীর হবে না পুরুষের হবে সেটি ঠিক হয় কয়েক মাস গর্ভে থাকার পরে। এত সব জটিল বিষয় আমাদের মত সাধারণ মানুষের মাথার উপর দিয়ে যায়। কিন্তু, এইটুকু বুঝেছিলাম, মানুষের নিজের জন্মগত নারী পুরুষের পরিচয় পরিবর্তন করার ইচ্ছে একদমই প্রাকৃতিক, এই জন্য ব্যক্তির উপর কোন দায় নেই। এর মাঝে আবার কিছু মানুষ আছে, যারা নারী বা পুরুষ নির্দিষ্ট কোন যৌনাঙ্গ বা মগজ নিয়ে জন্মায়নি। এরা নিজেদের নারী বা পুরুষ কিছুই ভাবতে পারে না বলা হচ্ছে ননবাইনারী (nonbinary)।
প্রাচীন নেটিভ আমেরিকান সমাজে চার ধরনের যৌন পরিচয়ের কথা জানা যায়- নারী সত্তার নারী, নারী সত্তার পুরুষ, পুরুষ সত্তার নারী, পুরুষ সত্তার পুরুষ। কিন্তু, ইউরোপ থেকে সাদা চামড়ার মানুষ আমেরিকায় গিয়ে চাপিয়ে দিল যে, দুনিয়াতে কেবল নারী আর পুরুষ এই দুই যৌন পরিচয়ের মানুষ আছে, আর সব শয়তানের সৃষ্টি। এখানেও মজার ব্যাপার ইউরোপের দার্শনিক প্লুটো তার লেখায় প্রাচীন সময়ে তিন ধরনের মানুষের কথা বলেছেন- নারী, পুরুষ এবং নারীপুরুষ মিলিয়ে। আরেকটি বিষয় হল, মানুষের যৌন পরিচয়ের (sexual identity) সাথে, তার যৌন অভিযোজনের (sexual orientation) কোন সম্পর্ক নেই।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামি’র বিখ্যাত উপন্যাস ‘কাফকা অন দ্যা শোর’ এর একটি চরিত্র ওশিমা’র কথা, যে দেখতে নারীর মত, কিন্তু যৌনাঙ্গ নারী বা পুরুষের নয়, আবার মগজে সে একজন পুরুষ এবং সে পছন্দ করত পুরুষ। এইসব জটিল বিষয়গুলো সাথে সমাজের মানুষের ভাবনা নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় আমেরিকান সিরিয়াল সেক্স এডুকেশনে খুব সুন্দর করে তুলে এনেছে। পশ্চিমারাই আবার এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলছে, সচেতন হচ্ছে। পশ্চিমের এত প্রগতিশীলতার পরেও, এঞ্জেলিনা জোলির মেয়ে শিলহ জোলি-পিটকে দীর্ঘ সময় মিডিয়ার এবং মানুষের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে, কেবল ছেলেদের মত পোশাক পরেছে আর চুল কেটেছে বলে। এঞ্জেলিনা জোলিকে শুনতে হয়েছে নানা কথা মেয়েকে ছেলেদের মত পোশাক পরাচ্ছে বলে বা চুল কেটতে দিয়েছে বলে। যৌন পরিচয় (sexual identity) প্রকৃতির হলেও, লিঙ্গ পরিচয় (gender identity) মানুষের আরোপিত। ওশিমাকে দিয়ে মুরাকামি তার লেখায় বলেছিল, প্রাচীন সময়ে মানুষ কেবল নারী বা পুরুষ ছিল না, তিন ধরনের মধ্যে যেকোনো একটি ছিল- পুরুষ/পুরুষ, নারী/পুরুষ অথবা নারী/নারী। অন্যভাবে বললে, প্রত্যেক মানুষ দুটি উপাদান দিয়ে তৈরি হয়েছিল। সবাই এতে খুশি ছিল, এবং এ নিয়ে খুব বেশি ভাবনা-চিন্তা করেনি। কিন্তু, তারপর ঈশ্বর একটি ছুরি নিয়ে সবাইকে মাঝ বরাবর দুইভাগে কেটে ফেলল। তারপর থেকে পৃথিবী কেবল নারী এবং পুরুষ এই দুইভাগে ভাগ হয়ে গেল। এরপর সব মানুষ তার হারিয়ে ফেলা বাকি অর্ধেক সত্তা খুঁজে বেড়াতে লাগলো।
নানা কিছু ভাবতে ভাবতে উঁচু নিচু পাহাড়ি পথ ধরে পোপা পর্বতকে পেছনে ফেলে গাড়ি ছুটে চলেছে বাগান শহরের ভেতরে ইরাবতী নদীর দিকে। ইরাবতী না দেখে তো বাগান থেকে যাওয়াই যাবে না।
rupsbd@gmail.com

প্রাচীন নেটিভ আমেরিকান সমাজে চার ধরনের যৌন পরিচয়ের কথা জানা যায়- নারী সত্তার নারী, নারী সত্তার পুরুষ, পুরুষ সত্তার নারী, পুরুষ সত্তার পুরুষ। কিন্তু, ইউরোপ থেকে সাদা চামড়ার মানুষ আমেরিকায় গিয়ে চাপিয়ে দিল যে, দুনিয়াতে কেবল নারী আর পুরুষ এই দুই যৌন পরিচয়ের মানুষ আছে, আর সব শয়তানের সৃষ্টি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু, মহান একুশ ও মুক্তিযুদ্ধ
পরবর্তী নিবন্ধলতা মঙ্গেশকর