বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। নির্বাচন হবে, নির্বাচন করে নির্বাচিত সংসদ ও সরকার হবে, যারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ হবে এবং জবাবদিহি হবে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে যে পরিবর্তন হয়েছে, আশা করবো সেটা সব রাজনৈতিক দল ধারণ করবে। আমি জানি বিএনপি সেটা ধারণ করেছে। বাংলাদেশের মানুষের মনে যে আকাঙ্ক্ষা জেগেছে, মানুষের মধ্যে যে পরিবর্তন হয়েছে, যে প্রত্যাশা সেটা বিএনপি ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। এজন্য আমি আশাবাদী।
দৈনিক আজাদীর সঙ্গে একান্ত আলাপে এসব কথা বলেন তিনি। এসময় ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের কর্মকাণ্ডকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?-এমন প্রশ্নে আমীর খসরু বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের খুব বেশি কিছু করার আছে বলে আমি মনে করি না। তারপরও তারা কিছু কিছু জায়গায় চেষ্টা করেছে। এটা তো আমরা লক্ষ্য করেছি, চেষ্টা তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) হয়তো করেছে, কিন্তু তো বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। এগুলোর জন্য একটা নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজন, জনসমর্থন দরকার।
খসরু বলেন, একটা দল যখন ক্ষমতায় যায় তারা বেশ জনসমর্থন নিয়ে যায়। সেই সমর্থনের মাধ্যমে তারা অনেক কিছু বাস্তবায়ন করে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে। নির্বাচিত সরকারের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। সবাই সকলের সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখেছে। তারা অপেক্ষা করেছে নির্বাচিত সরকার আসলে তাদের সিদ্ধান্তে যাবে। সবাই একটা প্রশ্ন করে, নির্বাচন কবে? ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, এমনকি নিজস্ব পারিবারিক সমস্যার সমাধান অনেকে বলে, আগে নির্বাচনটা হোক তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নেব। মানে সামাজিকভাবে, সব জায়গায় সবাই নির্বাচনের অপেক্ষা করছে। একটা নির্বাচিত জনগণের সমর্থিত সরকার না থাকলে কোনো ধরনের বড় ধরনের নীতিগত নীতিমালার সিদ্ধান্ত যাওয়া সম্ভব না। এটার জন্য একটা সমর্থনের দরকার, পলিটিক্যাল ব্যাকিং এর দরকার। সেটার জন্য তো সবাই অপেক্ষা করছে।
এক প্রশ্নের জবাবে খসরু বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তো অন্তর্বর্তী সরকার। তারা হচ্ছে ট্রানজিশনাল গভর্মেন্ট। অর্থাৎ একটি স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট থেকে মুক্ত দেশকে আবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা ট্রানজিশনাল পিরিয়ড। এই ট্রানজিশনে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রবর্তনের প্রথম চেষ্টা তাদের থাকতে হবে। এর মধ্যে যে সংস্কারগুলোর কথা বলা হয়েছে, যেখানে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে, আর বাকিগুলোর বিষয়ে প্রত্যেকটি দল জনসাধারণের কাছে যাবে।
তিনি বলেন, সবকিছুতে ঐকমত্য হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ প্রত্যেক দলের নিজস্ব দর্শন আছে, তাদের চিন্তা–ভাবনা আছে এবং ভবিষ্যৎ রূপরেখা আছে। আমরা তো আর বাকশাল করছি না যে, সবকিছু এক হয়ে যাবে। সুতরাং তাদের প্রক্রিয়া যেটা ছিল, সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য যতটুকু হয়েছে সেটা বাস্তবায়নের বাইরে তাদের কিছু করার নেই। কারণ কাউকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। এর বাইরে গেলে জনগণের কাছে যেতে হবে সবাইকে। সুতরাং আমি আশা করি ওই প্রক্রিয়ার দুয়কদিনের মধ্যে সমাধান হয়ে যেতে পারে।
খসরু বলেন, জুলাই সনদ তো ঘোষণা হয়েছে। সনদের মধ্যে সংস্কার আসবে। যতটুকু ঐকমত্য হয়েছে ততটুকু সনদে থাকবে, বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ‘কেউ কেউ বলছেন যে আগে সংস্কার, তারপর নির্বাচন। কিন্তু কমপ্লিট সংস্কার, এটা তো একটা লং প্রসেস। বিষয়টা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন’– এমন প্রশ্নে আমীর খসরু বলেন, যেগুলো ঐকমত্য হবে সেগুলো নিয়ে তো কারো দ্বিমত নেই। তাছাড়া কমপ্লিট সংস্কার বলে কোনো কিছু নেই দুনিয়াতে। সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া, এটা আগামী ১০০ বছর ২০০ বছরও হবে। কমপ্লিট সংস্কার বলে কিছু নেই। যারা বলে সংস্কারের সম্বন্ধে তাদের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।
তিনি বলেন, বিএনপি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে একদলীয় শাসন থেকে বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে, এট সংস্কার না? সরকারচালিত অর্থনীতি থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতি করেছে, এটা সংস্কার না? যত অর্থনৈতিক সংস্কার হয়েছে, যত রাজনৈতিক সংস্কার হয়েছে, সংসদীয় পদ্ধতি বিএনপির নেতৃত্বে এগুলো সংস্কার না? আমি লম্বা লিস্ট দিতে পারব, শত শত সংস্কার হয়েই তো দেশ একটা উন্নয়নের জায়গায় গেছে। শেখ হাসিনা সেটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে সেটা অন্য কথা। তার আগে তো বাংলাদেশে উন্নয়নের দিকে যাচ্ছিল। আমরা যখন সরকার থেকে বের হয় তখন ৭ দশমিক ০৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল, এইটার ধারা উপর দিকে চলছিল। যদি সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, নির্বাচনের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকতো তাহলে তো এটা ১০– ১২ শতাংশে চলে যেত। শেখ হাসিনা ধ্বংস করে দেওয়ার সাথে তো সংস্কারের বিষয় না। সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া এবং সেটা চলতে থাকতে থাকবে। ও (শেখ হাসিনা) নষ্ট করে দিয়েছে, এটা আরো বেশি করে আমাদের কে এই জিনিসগুলো শুদ্ধ করতে হবে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে আমীর খসরু বলেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ্বে তো নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমরা আশা করি এটা বাস্তবায়ন হবে। এরপরে তো রমজান, রমজানের পর নির্বাচন দেওয়া সম্ভব না। লন্ডনের মিটিং–এ তো সেটাই সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন তো একটা ডেটও তো মোটামুটি চলে আসছে।
‘প্রচলিত ও পিআর পদ্ধতির নির্বাচন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খসরু বলেন, বাংলাদেশে আমরা ওয়েস্ট মিনিস্টার টাইপ পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি ফলো করি এবং এই পদ্ধতি আমাদের খালি নির্বাচন না, এটা আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। বিশ্বের কয়েকটি উন্নত দেশে যেখানে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র এখনো সফলভাবে চলছে, ব্রিটেন হচ্ছে একটি দেশ আমরা সেটাই ফলো করি। সেখান থেকে সরে যাওয়ার ইচ্ছে কারো থাকতে পারে, কিন্তু আমরা তো সেটাকে বাতিল করতে পারবো না। বাতিল করতে চাইলে তাদেরকে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সেটা করতে হবে, আগামী সংসদে নিয়ে আসতে হবে। তাদের ইচ্ছা (পিআর পদ্ধতি) থাকতে পারে, আমি তো আরেকজনের মতামতকে উপেক্ষা করতে পারব না। আমি তার সাথে দ্বিমত পোষণ করে সম্মান দেখাচ্ছি। কিন্তু সেটা আগামী নির্বাচনে তাদেরকে জনগণের কাছে ম্যান্ডেট নিয়ে সংসদে এসে পাশ করতে হবে।
আমীর খসরু বলেন, আমার কাছে মনে হচ্ছে শেখ হাসিনা যাওয়ার পরেও কিছু ক্ষুদে ক্ষুদে স্বৈরশাসক রেখে গেছে, ফ্যাসিস্ট রেখে গেছে। এটা তো অগণতান্ত্রিক চিন্তা। এটা মানতে হবে, না মানলে এটা হবে না, সেটা হবে। এখন বিএনপি যদি বলে ৩১ দফা মানতে হবে, না হলে আমি যাব না নির্বাচনে, এটা কি হবে? হবে না। তো জনগণের কাছে যেতে হবে। সবার ওই মন মানসিকতা থাকতে হবে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠির চাহিদা তো এখানে পূরণ করার সুযোগ নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে আমীর খসরু বলেন, আমাদের সহনশীল হতে হবে। রাজনৈতিক কালচার চেঞ্জ করতে হবে না? আরেকজনের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেও সম্মান জানাতে তো অসুবিধা নেই। ভিন্নমত তো থাকবে রাজনীতিতে, কিন্তু একেবারে সাংঘর্ষিক, রাজনীতির রক্তক্ষয়ী শত্রু, এ রাজনীতি তো বাংলাদেশের মানুষ খাবে না। মানুষ ওইটাই খাবে, যে গণতান্ত্রিক মন মানসিকতা থেকে কথা বলতে হবে, আরেকজনের মতকে দ্বিমত হলেও সম্মান দিতে হবে। এই কথাগুলো আমি প্রত্যেক দিন বলছি, তারেক সাহেবও (বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) একই কথা বলছে।
তিনি বলেন, মানুষ এখন বেশি পলিটিঙ চায় না। ও চিন্তা করছে আগামী দিনে তার ছেলে লেখাপড়া করতে পারবে কিনা, স্বাস্থ্যসেবা পাবে কিনা, ছেলে মেয়ে চাকরি পাবে কিনা, মানুষের চিন্তা এখন এগুলো। এই কথাগুলো আমরা বলছি, মানুষকে আমি কি দেব, আমার পরিকল্পনা কি বুঝাতে হবে। মানুষের জানতে হবে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের জন্য কি করবে। মানুষের এইটাই প্রত্যাশা।