আমাদের দেশে রাজনৈতিক মতাদর্শের বিভক্তি, অসহিষ্ণুতা, উগ্রতা, হামবড়া, দাম্ভিকতার নগ্ন প্রকাশের রুদ্রমূর্তি শুধু দলে নয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বেচ্ছাচারী মতাদর্শরূপে এতো বেশি প্রকট ও ভয়াবহ যে, সেটা অনেক বড় বিষফোঁড়া হয়ে গেছে জাতির শরীরে! বিভক্তিটা পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়–স্বজন, চেনা–অজানা মানুষ,কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী, দোকানের ক্রেতা–বিক্রেতা, যানবাহনের ড্রাইভার– পেসেঞ্জার হতে শুরু করে ভার্চুয়াল–এ্যাকচুয়াল বন্ধুবান্ধব সবার মধ্যেই সংক্রমিত হয়ে প্রবল আকার ধারণ করে আছে! কথিত আছে বাঙালির জীবনে সবচেয়ে সস্তা ও মুখরোচক বিনোদন হলো ‘রাজনীতি ও পরচর্চা’! আমাদের জাতিগত এই বৈশিষ্ট্যের আওতায় আমরা পথে ঘাটে, হাটে মাঠে, অফিসে–রেস্টুরেন্টে সর্বত্র নিজেদের রাজনৈতিক সচেতনতা আর জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় পাণ্ডিত্য জাহির করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বা কার্পণ্য না করা জাতি!
তা সত্ত্বেও আমরা রাজনৈতিকভাবে দেওলিয়াপনার দোষে দুষ্ট! আমাদের পারস্পরিক কথোপকথনগুলোতে যতোটা সঠিক তথ্য বা বস্তুনিষ্ঠতা থাকে তার চেয়ে বেশি থাকে বানোয়াট গল্প, মিথ্যে রটনা, ব্যক্তি চরিত্র হনন,গুজব আর মনের মাধুরী মিশ্রিত পছন্দনীয় ব্যক্তি ও দলের প্রতি আবেগময় অতিরঞ্জিত ও ক্ষতিকর বহিঃপ্রকাশ! যার কারণে দ্বিপাক্ষিক আলোচনাগুলো গঠনমূলক সত্যনিষ্ঠ আর বস্তুনিষ্ঠতা বজায় না থেকে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ, ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে চলে যায়। ব্যক্তি চরিত্র হনন বা অন্যকে হেনস্তা ও অপদস্ত করাটাও হচ্ছে অহরহ। ক্ষেত্রবিশেষে স্থান–কাল–পাত্র বিবেচনায় স্থান না পেয়ে এসব কিছু অশোভন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে! এমনকি শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণগুলো কুশ্রীরূপ ধারণ করে প্রায়শই! এতে পারস্পরিক সম্মান এবং সম্পর্কের চরম অবনতিও দৃশ্যমান হচ্ছে ভার্চুয়ালি এবং মুখোমুখি! সৌহার্দ্য–সম্প্রীতি–আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্কগুলো যে এখন কতোটা ঠুনকো হয়ে গেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না! অথচ পৃথিবী এখন সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জ্ঞান–বিজ্ঞান–প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় সমৃদ্ধির পথে অনেক এগিয়ে গিয়ে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার’ যুগে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আমরা এখনো লড়ে যাচ্ছি নিজেদের বিভিন্ন মতাদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব, নিজেদের মীমাংসিত ইতিহাস–ঐতিহ্য–কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং আপন শিকড়কে বিতর্কিত করতে! অথচ এগুলো নেহায়েতই আমাদের কাণ্ডজ্ঞানহীনতা, অর্বাচীনতা ও জ্ঞানপাপীতুল্য বা কুয়োরব্যাঙের মত আচরণ! ন্যূনতম বোধ–বিবেচনা থাকলে বোঝা উচিৎ কোন কিছু নিয়েই বাড়াবাড়ি করা উচিৎ নয়। বাড়াবাড়ির ফল শুভ হয় না অশুভই হয়! এটা সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুলআলামিনের তরফ থেকে মানবজাতির প্রতি কঠিন সাবধান বাণী! অথচ আমরা প্রবল স্বেচ্ছাচারী, হামবড়া এবং উদাসীন!
যেখানে আমাদের জরুরি করণীয় হলো দারিদ্র্যমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, বেকারত্বমুক্ত, শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ, ন্যায়ভিত্তিক, আইনের সমতাভিত্তিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এগিয়ে যাওয়া উন্নত পৃথিবী এবং অগ্রসর সমাজের সাথে সঙ্গতি রেখে সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য দেশকে গড়ে তোলা। অসংখ্য মেধাবী, পরিশ্রমী, দক্ষ জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও আমরা বারবার হোঁচট খেয়ে পড়ছি, ঘুরপাক খাচ্ছি শুভঙ্করের ফাঁকির ফাঁদে! এ থেকে উত্তরণ সম্ভব না হলে সমাজে শান্তি আসবে না এমনকি দেশ কখনো সঠিকপথে এগোতে পারবে না এটা নিশ্চিত!