মোটাকে মটকু বলা, খাটোকে বাইট্টা বলা, কালোকে কাল্লু বলে ব্যথা দেওয়া ঘোরতর অসভ্যতামি। নিশ্চিত পাপ। যার যেখানে ব্যথা সেখানে টিপ্পনি কাটার অ–কাজটি বিবেকবানরা করে না। কিছু কিছু অপূর্ণতায় সৃষ্টির শোভা বাড়িয়েছে। কারো আর্থিক সমস্যা, কারো মানসিক বিকাশে ত্রুটি–সেটা বারবার বলে, ঘুরে–ফিরে শুনিয়ে যদি কেউ তৃপ্তি পায় তবে তার ভেতরটা পঁচে গেছে। মানুষের চামড়া চর্বিসহ অধিক পুরু বলে ভেতরের গন্ধ বাহিরে আসে না বটে তবে কথার গন্ধ ছড়ায় সবখানে!
শরীরের আকৃতি, গায়ের রঙ এসব মানুষকে মাপার মানবসৃষ্ট মাপকাঠি হতে পারে কিন্তু স্রষ্টার সৃষ্টিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার অধিকার মানুষকে দেয়া হয়নি। লৌকিক চোখের সুন্দর–যুঁতসইয়ের মধ্যে কত খুঁত থাকতে পারে কিংবা আছে তা মিশলে বোঝা যায়! স্বার্থের সম্পর্কে জড়ালে ধরা পড়ে! কতক্ষণ কথা বললে প্রকাশিত হয়। শারীরিক ত্রুটি নিয়ে হাসাহাসি মানসিকভাবে বিকৃতিগ্রস্তদের দ্বারাই সম্ভব! কথিতশিক্ষিত মানুষ দিয়েও এই পাপ প্রকাশিত হতে পারে তবে মহৎ মানুষ দিয়ে হয় না! তাঁরা কাউকে ব্যথা দিয়ে সুখ পায় না!
ফর্সার ওপর অন্ধ হয়ে ভরসা করা যায়? কত ফিটফাট ঘরে নির্যাতন করে আর বাইরে সাধু সাজে, চেয়ার অলঙ্কৃত করে এবং রঙমহল চালায়–সেসবের ইয়ত্তা আছে? তবে ভালোকে ভালো বলতেই হবে। সে যে আকৃতিতে থাকুক, যে অবয়বে নিজেকে দেখাক! এই সমাজে মানুষের বড্ড অভাব। সে রীতি–নীতি হারিয়ে ফেলেছে, চরিত্রে দাগ ফেলেছে, প্রতিশ্রুতি ভুলে গেছে। বাহ্যিক সৌন্দর্যের টানে ত্বক ফর্সা করার বাহারি ক্রিম–স্নো–র উদ্ভব হয়েছে অথচ মানুষ বানানোর কারখানাগুলো দিনদিন বিকল হচ্ছে!
চারপাশে দ্বিপদ চতুর জীবের রমরমা বাজার অথচ সোনার মানুষ, ভালো মানুষ এবং বিশ্বস্ত মানুষ হাটবারেও হাঁটে না। দিনদিন কমে যাচ্ছে। রোজার মাসে মানুষ একবার সংযমের কথা বলে আর তিনবার মুনাফার কথা বলে! এখানে বোধহয় এমন কোনো খাদ্য নাই যেটাতে অল্প–বিস্তর ভেজাল না মিশছে! এমন মানুষ খুব কম আছে যারা অসাধুভাবে অর্থবান হওয়ার মওকা পেয়েও সাধু আছে! লোভ সংবরণ করে এখনো মানুষের কাতারে টিকে আছে! স্বার্থের জন্য হরদম মিথ্যার বেসাতি জমেছে! ক্রেতা–বিক্রেতায় বসেছে হাটবার!
নিজেকে ভালো করার তপস্যা দেখার সৌভাগ্য চোখের হচ্ছে না অথচ মন দেমাগে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে! হাত–পা কিংবা শরীর নিজের কল্যাণে যতখানি নিয়োজিত তার অধিক ক্রিয়াশীল অপরের ক্ষতিতে। মুখ হরদম বলে যাচ্ছে যা ইচ্ছা তা! স্বার্থের দ্বারা সে সম্পর্কের খুনি হচ্ছে। দূরে ঠেলে রাখছে প্রিয়জনকে! ঠেকে গেলেই বলছে, “আমি অপরাধী হলে আল্লাহ আমার বিচার করবে কিন্তু অপরাধ তোমার হলে, তোমার যেনো ধ্বংস আনে।‘” নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার, নিজেকে সাধু সাজাবার এটাই মোক্ষম অস্ত্র! অথচ এদের জীবদ্দশাতে আর কোনো কাজেই যেন খোদাকে দরকার হয় না!
মানুষকে ব্যথা দিয়ে যে সুখ তা অসুখে ভরা। কথায় কোমল হলে, অপরকে সম্মান দিলে, কারো কাছে বিনীত হলে তারচেয়ে মহত্তম স্বভাব আর কিছুই হতে পারে না। কাউকে আঘাত দিয়ে, তাচ্ছিল্যভরে অসম্মান করে ভালোবাসা পাওয়া যায় না; তা সে যতই ক্ষুদ্র হোক। ভয়ে নমঃ নমঃ বলতে পারে কিন্তু বুকের ভেতরেও কিছু শব্দে কবিতা হয়– যেখানে ঘৃণা এবং গালি ছাড়া আর কিছুই থাকে না। মৌনতা কখনো কখনো শক্তিশালী প্রতিবাদ! এই একজীবনে সব হিসাবের হিস্যা মিটিয়ে দেয়া হবে না! সেদিন আশ্চর্য হতে হবে–একি! এসব জুটলো কোথা থেকে?
কারো জন্য বিশ্বাসের পাত্র হতে পারা, দুঃখের উপশমকারী হওয়া, ভরসার আশ্রয়স্থলে পরিণত হওয়ার চেয়ে বড় কোনো পুণ্যের আমল নাই। কাউকে অযৌক্তিক ব্যথা না দিয়ে, কারো ঘৃণা নিজের সাথে বয়ে না বেড়ালে সে জীবন আলোকের সাক্ষাৎ পাবে। শ্বাস–প্রশ্বাসে বইবে বুকভরা ভালোবাসা। একবুক ভালোবাসা আকাশের চেয়ে বিশাল, মহাসাগরের চেয়েও অতল! আর কাউকে দমিয়ে রেখে, কথায়–আচরণে আঘাত দিয়ে, অশ্রু ফোঁটার কারণ হয়ে অকারণে জীবনে দীর্ঘশ্বাস জড়ানো উচিত হবে না। বরং সম্মান করে, সম্পর্ক বাঁচিয়ে রেখে পাশাপাশি মিলেমিশে থাকার থেকে উত্তম আয়োজন আর কিছুতেই নাই! অল্পদিনের জীবন খাতায় অনেক শত্রুতে কবিতা লিখলে শান্তির সুবাসাতাস কোন পথে আসবে? কে দেখাবে বাঁচিয়ে রাখার জোছনা?