একলোক রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় ঘরের ভিতর হাঁটেন। অনেক সময় দরজা খুলে বের হয়ে যেতে চান। প্রায় দুঃস্বপ্ন দেখেন, সাথে হাসেন ও কাঁদেন। কখনো ঘুমের মধ্যে মনে হয় কেউ তার বুক চাপ দিয়ে ধরে রেখেছেন, কিন্তু বলতে পারছেন না। নির্জনে বিভিন্ন রকমের আওয়াজ শুনেন। অনেক সময় মনে করেন তার জীবন সঙ্গী তাকে ঘুমের মধ্যে আক্রমণ করতে পারে। তাই তিনি বিছানার কাছে চাকু রাখেন। মনে করেন তাকে কেউ সবসময় ফলো করছে। আবার মনে করেন তার ক্ষতির মূলে হচ্ছে নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তি। তিনি চাকরি ব্যবসা কোনো কিছুতেই সন্তুষ্ট নন, তার ধারণা আরো ভালো কিছু করা উচিত। সব সময় চরম হতাশায় ভুগেন। তাই মাঝেমধ্যে আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসে। আবার কোনো কোনো সময় অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ান এবং কেউ উন্নতি করলে তার সহ্য হয় না, সেজন্য নানান কথা রটান। পরিবারের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা থাকা দায়িত্বশীল মানুষটি হঠাৎ আত্মহত্যা করে বসেন। আপনজনেরা ভেবে পান না, কেন তিনি আত্মহত্যা করলেন? কেন পরিবার তাঁর কষ্টের সঙ্গী হতে পারলো না? একজনের মুখে সব সময় থাকত মা বাবা আর ছোট ভাইয়ের কথা। সে হঠাৎ একদিন স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নেয়। কিন্তু কেন? সে প্রশ্নের জবাব খুঁজে পান না পরিবারের সদস্য, স্বজন ও বন্ধুরা।
উপরে যে ঘটনাগুলো বর্ণনা করলাম, সবই মানসিক রোগের লক্ষণ। যা আমাদের সমাজে হরহামেশাই দেখা যায়। কিন্তু বুঝে হোক বা না বুঝে হোক আমরা বিষয়গুলো সিরিয়াসলি নিই না। তাই এসব মানসিক অসুস্থ লোকগুলোকে সমাজে চরম পরিণতি ভোগ করতে হয়।
মানসিক অসুস্থতা খুব স্পর্শকাতর একটি রোগ। বিশ্বে এটি একমাত্র রোগ যা রোগী নিজে স্বীকার করে না। যারা আক্রান্ত তাদেরকে বলা যায় না, তারা অসুস্থ। যদি কোনো মানসিক রোগীকে চিকিৎসা করানোর কথা বলা হয়, তবে তিনি ক্ষেপে যান। পারিবারিক সম্মানের কথা ভেবে অনেকে মানসিক অসুস্থতায় ভোগা ব্যক্তির রোগের কথা প্রকাশ করেন না বা স্বীকার করেন না। অনেকে মনে করেন তাবিজ–কবচ ও ঝাড়ফুঁকে এই রোগ সারে।
অনেকের ধারণা দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা অতি সামান্য। কিন্তু জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৮–১৯ অনুসারে দেশে প্রাপ্তবয়স্ক প্রায় ১৭% মানুষ মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন। শহরে এই হার ১৮.৭%। এতে উদ্বেগজনিত অসুস্থতা প্রায় ৫% এবং বিষণ্নতাজনিত অসুস্থতা প্রায় ৭%। যার মধ্যে চিকিৎসাসেবার বাইরে আছেন ৯২% মানুষ। শহরাঞ্চলে পুরুষের তুলনায় নারীর মানসিক অসুস্থতার হার তুলনামূলক বেশি। শিশুদের ক্ষেত্রে মানসিক অসুস্থতার হার প্রায় ১৪%। যার মধ্যে ৯৫% শিশুর চিকিৎসা করানো হয় না।
মানুষ কেন মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা করাতে চায় না–জানতে ২১৬ জনের ওপর এক গবেষণা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট। দেশের ৮টি বিভাগে ১২ বছর থেকে বিভিন্ন বয়সী নারী পুরুষ ও শিশুর সঙ্গে ৩৩টি দলগত আলোচনা ও ২৩টি সাক্ষাৎকারে সমস্যাগুলো তুলে আনা হয়। যুক্তরাজ্যের কমিক রিলিফ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহায়তায় ও অ্যাকশন অন ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এডিডি) ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশের সহযোগিতায় ২০২২ সালের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তিন ধাপে এই গবেষণা হয়। ‘আউটস্ট্যান্ডিং দ্য ইমপ্যাক্ট অব স্টিগমা অন পিপল উইথ মেন্টাল ইলনেস ইন বাংলাদেশ’ (বাংলাদেশে মানসিক অসুস্থতায় ভোগা ব্যক্তিদের প্রতি কুসংস্কারের প্রভাব পর্যালোচনা) শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে।
মানসিক অসুস্থতায় ভুগেছিলেন, গবেষণায় এমন কয়েকজন তাঁদের প্রতি মানুষের বিরূপ আচরণের কথা জানান। তারা জানান পরিবারের সম্মানহানির আশঙ্কায় অনেকে মানসিক অসুস্থতার বিষয়টি জনসমক্ষে আনতে চান না। তাই চিকিৎসক দেখান না। বিশেষ করে মেয়ে হলে ‘বিয়ে হবে না’ এমন ভাবনা কাজ করে। কর্মক্ষেত্রে দেখা যায়, মানসিক অসুস্থতা ধরা পড়ার পর সুস্থ হলেও চাকরি টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে স্কুলে ভর্তি করানো কষ্ট হয়। মানসিক সমস্যা রয়েছে এমন সদস্যকে নিয়ে পরিবার হীনম্মন্যতায় ভোগে। কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চায় না। সুস্থ হয়ে ফিরে এসেও হরহামেশা নেতিবাচক কথা শুনতে হয়। চলতে ফিরতে শুনতে হয়, তুমি তো পাগল ছিলে, এখন কী অবস্থা? বিয়ে করতে গেলে এদেরকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়।
মনোচিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীরা মনের অসুখ শনাক্ত করতে, মনের যত্ন নিতে নানা উপদেশ দিলেও এ দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেকেই এটাকে কোনো সমস্যা মনে করেন না। ফলে মনকে কখন অসুস্থতা গ্রাস করে, সেটা টের পান না। একা থাকলে সেই অসুস্থতা ভয়ানক অবস্থায় পতিত হয়। তিনি ভাবেন, তাঁর মনের কথা শোনার লোক নেই।
মনোচিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীদের অভিমত শুধু মন খুলে কষ্টের কথা, সমস্যার কথা বলতে না পেরে অনেকে মানসিকভাবে ক্ষয়ে যেতে থাকে। জীবনশক্তি কমতে থাকে, কাজের আগ্রহ হারিয়ে যেতে থাকে। বাড়তে থাকে দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা যা জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মানসিক সমস্যা যে রয়েছে সেটা আগে মেনে নিতে হবে। নইলে চিকিৎসা সম্ভব না।’ গবেষণায় বলা হয়েছে, সমাজে মানসিক অসুস্থতায় ভোগা ব্যক্তিদের ‘ভীতিকর কিছু’ মনে করেন। তাঁদের ধারণা, মানসিক অসুস্থতায় ভোগা ব্যক্তিরা যখন তখন হামলা করতে পারে।
গবেষণায় এক মনোচিকিৎসক নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘মাত্র ৫% রোগী আসেন কোনো ঝাড়ফুঁক না করে। শিক্ষিত বা অশিক্ষিত হোন বাকি ৯৫% মানসিক অসুস্থতাকে মনে করেন ‘জিন–ভূতের আছর’। স্ত্রী স্বামীর পরকীয়া, শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না থাকা, পেশাগত জীবনে স্বামীর ছাড় না দেওয়া, সংসারে সময় না দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে অনেকেই বিষণ্নতায় ভোগেন। সাত বছরের এক শিশু চরম মারমুখী হয়ে উঠেছিল। কাউকে সহ্য করতে পারত না। পড়াশোনায় ছিল অমনোযোগী। মা বাবা প্রথমে ভেবেছিলেন, ছেলে হয়তো স্কুলে সহপাঠীদের বুলিংয়ের শিকার। চিকিৎসক একান্তে তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, বাড়িতে এক পুরুষ আত্মীয়ের মাধ্যমে সে নিয়মিত যৌন হয়রানির শিকার হতো। এক কিশোরের মুঠোফোনের আসক্তি চরমে পৌঁছেছিল। মা বাবা প্রথমে মুঠোফোন কেড়ে নিতেন। এতে কিশোর জিনিসপত্র ভাংচুর শুরু করত। এক প্রেমিক কৌশলে কিশোরী মেয়েটির নগ্ন ছবি নেয়। সেই ছবি দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল শুরু করলে আত্মহত্যার চেষ্টা করে মেয়েটি।
তবে মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা না হলে ধীরে ধীরে ওই ব্যক্তি কর্মদক্ষতা হারিয়ে ফেলে। দীর্ঘ মেয়াদে মানসিক সমস্যা তীব্র হয়। অনেক সময় রোগী আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে, আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়তে পারে। তাঁকে ঘিরে পুরো পরিবারে বিষণ্নতা–হতাশা দেখা দিতে পারে। তাই মানসিক অসুস্থতায় ভোগা রোগীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। অন্যান্য রোগের মতো দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। রোগীকে মন খুলে কথা বলতে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে মানসিক অসুস্থতা শনাক্ত করে চিকিৎসা দিতে না পারলে তা একসময় পরিবার ও সমাজের জন্য বড় ধরনের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক: কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক।