মানবাধিকার ও শ্রমিকের অধিকার

ফজলুল কবির মিন্টু | বৃহস্পতিবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ

১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাকে কার্যকর করার লক্ষে এদিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। মানবাধিকার বলতে আমরা বুঝি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিটি মানুষের জন্মগত ও মৌলিক অধিকার। পুরুষের অধিকার, নারীর অধিকার, দাসত্ব থেকে মুক্তির অধিকার এবং শ্রমিকের অধিকার ইত্যাদিকে সামগ্রিক অর্থে মানবাধিকার বলা হয়। মানবাধিকার প্রশ্নে সমাজের অপারপর অংশের তুলনায় শ্রমজীবী বা শ্রমিক শ্রেণীই মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয় সবচেয়ে বেশি।
সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ১৯৪৮ এর ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রত্যেক কর্মীর তার নিজের ও পরিবারের মানবিক মর্যাদা রক্ষার নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম, এমন ন্যায্য ও অনুকূল পারিশ্রমিক এবং প্রয়োজনবোধে সেই সংগে সামাজিক সুরক্ষার অধিকার রয়েছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ৭ম অনুচ্ছেদে ন্যায্য মজুরী, সমান কাজে সমান মজুরী, শোভন জীবন যাপন, স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ কর্ম পরিবেশ, কর্ম ক্ষেত্রে সমান সুযোগ, বিশ্রাম ও সবেতনে ছুটি সংক্রান্ত অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
উপরোক্ত ঘোষণা, চুক্তি এবং আই এল ও কনভেনশন এর আলোকে গঠিত বাংলাদেশ শ্রম আইনে কর্ম ঘণ্টা, ছুটি, মজুরী, মজুরী পরিশোধের সময়কাল, নিরাপদ কর্ম পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে।
আজকের সামাজিক, রাষ্ট্রিক বাস্তবতায় বিভিন্ন আইন, কনভেনশন, চুক্তি, সাংবিধানিক অধিকার সমূহ সংজ্ঞায়িত থাকলেও পদে পদে এর লঙ্ঘন তথা শ্রমিকের অধিকার বঞ্চনার ঘটনা অহরহ ঘটছে আমাদের সমাজে।
বৈশ্বিক শ্রম অধিকার পরিস্থিতি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত নাজুক। বৈশ্বিক শ্রম অধিকার বিষয়ক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন (আইটিইউসি) সমপ্রতি তাদের ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্যের বার্ষিক প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ যে ১০টি দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের নাম রয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের ওপর সরকার ও নিয়োগকর্তার চাপিয়ে দেয়া অব্যাহত ভোগান্তির কারণে বাংলাদেশ রেটিংয়ে ৫ এর মধ্যে সর্বোচ্চ তথা ৫ পেয়েছে, যার অর্থ হলো- এখানে শ্রমিকদের ‘অধিকারের কোনো নিশ্চয়তা নেই’। সংগঠনটির বিগত ২টি বার্ষিক প্রতিবেদনেও বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম ছিল। আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ তে শ্রমিকদের স্বাধীনভাবে সংগঠিত হওয়া এবং দরকষাকষির অধিকারের কথা বলা হলেও বাংলাদেশের শ্রম আইনে প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে।
শ্রমিকের বঞ্চনার যাত্রা শুরু হয় মূলত চাকরিতে যোগদানের পর থেকেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে হোটেল রেস্টুরেন্ট, বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত এবং শিপ ব্রেকিং সেক্টরসহ বিভিন্ন সেক্টরে কমর্রত অধিকাংশ শ্রমিককে নিয়োগ পত্র ও পরিচয় পত্র প্রদান করা হয় না। ফলে এই সকল সেক্টরে কর্মরত শ্রমিকদের মজুরী কিংবা নিয়োগ সংক্রান্ত কোন সমস্যা হলে মালিক পক্ষ তাদেরকে শ্রমিক হিসাবেই স্বীকার করে না। এই অবস্থায় তারা যে ঐ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক সেটা প্রমাণ করা শ্রমিকদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। গার্মেন্টস গুলোতে কমপ্লায়েন্স অডিট পাশ করার জন্য শ্রমিকদের ব্যক্তিগত নথিতে নিয়োগ পত্র সংরক্ষিত থাকলেও নিয়োগ পত্রের কপি এখনো অনেক গার্মেন্টসের শ্রমিকদের প্রদান করা হয় না। অথচ বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ৫ ধারায় সকল শ্রমিক কে নিয়োগ পত্র ও পরিচয় পত্র প্রদানের কথা সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে।
শ্রম আইন ১২৩(১) ধারা মোতাবেক মজুরীকাল শেষ হওয়ার ৭ কর্ম দিবসের মধ্যে মজুরী পরিশোধের বিধান থাকলেও এখনো অনেক কলকারখানায় এই নিয়ম মানা হচ্ছে না। এই ব্যাপারে তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ নির্বিকার। ফলে শ্রমিকরা বকেয়া মজুরী আদায়ের দাবীতে অনেক সময় রাজপথে নামতে বাধ্য হয়। শ্রম আইনে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকদের সবেতন ছুটি সংক্রান্ত বিষয়ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয় না। এমনকি মালিক কর্তৃক শ্রমিকের চাকরি অবসানের যে একাধিক ধারা রয়েছে তার কোনটি অনুসরণ না করে কেবল মোখিক নির্দেশে চাকরিচ্যুত করা হয়। সমপ্রতি কোভিড-১৯ কালীন তা অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমিকেরা স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিলেও শ্রম আইনে বর্ণিত সার্ভিস বেনিফিট বা গ্র্যাচুইটি দেয়া হয় না।
প্রতিকার পাওয়ার জন্য শ্রমিকেরা আদালতের দ্বারস্থ হলেও বিড়ম্বনার শেষ নাই। শ্রম আইনের ২১৬ এর ১২ উপধারায় বর্ণিত আছে মামলা দায়েরের ৬০ দিনের রায় বা রোয়েদাদ প্রদান করতে হবে। আবার ১৩ উপধারায় বর্ণিত আছে ৬০ দিনের মধ্যে রায় প্রদান সম্ভব না হলে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে আদালত আরো ৯০ দিন সময় বর্ধিত করতে পারবে। এর অর্থ দাঁড়ায় একটা মামলা দায়েরের পর থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ দিনের মধ্যে রায় প্রদান করতে হবে। এর বেশী সময় নেয়ার কোন সুযোগ নাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলতে হয় শ্রম আইনের এ ধারাটি শ্রম আদালতের বিচারকগণ গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেন না। ফলে কোন মামলাই ১৫০ দিনের মধ্যে শেষ হয়েছে এমন নজির আমাদের জানা নেই।
সমপ্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কর্তৃক গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট-২০২০-২১-এ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ন্যূনতম মজুরী দেওয়ার বেলায় বাংলাদেশ সবার পেছনে। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের ন্যূনতম মজুরী আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দারিদ্র্যসীমার নিচে। ক্রয়ক্ষমতার বিবেচনায় ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মাসিক ন্যূনতম মজুরী ছিল ৪৮ ডলার। বাংলাদেশে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নেই। নির্দিষ্ট কিছু খাতের জন্য পৃথক মজুরিকাঠামো আছে।তবে অদক্ষ ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের মজুরী বিবেচনা করে এই হিসাব দিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। আইএলও’র উপরিউক্ত প্রতিবেদন প্রমাণ করে বাংলাদেশে আয় বৈষম্য প্রকট।
জাতিসংঘ ২০৩১ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (ঝউএ) নির্ধারণ করেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার উদ্দেশ্য আয় বৈষম্য কমানো কিন্তু বাংলাদেশে আয় বৈষম্য দিনের পর দিন বাড়ছে। পৃথিবীর ৫০% সম্পদের মালিক মাত্র ১% মানুষ। সুতরাং এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সাধারণ এবং শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যের কি পরিবর্তন হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। তাই আয় বৈষম্য কমানোর লক্ষে দুর্নীতিবাজ লুটেরা ধনিকদের হাত থেকে অবৈধ সম্পদ ও বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধার না করলে মানবাধিকার তথা শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে পদে পদে শ্রমিকরা শোষণ বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। কর্মঘণ্টা, ন্যায্য মজুরী, নিরাপদ কর্ম পরিবেশ সবকিছুই যেন আজ অলীক স্বপ্ন। ৮০% এর অধিক শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘন্টার বেশী কাজ করে। রাত দিন অমানুষিক পরিশ্রম করে শ্রমিকরা যে মজুরী পায় তা দিয়ে দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতির এই বাজারে বেঁচে থাকা আজ কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারি তদারকি সঠিকভাবে পালিত না হওয়ার কারণে শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে। ফলে পেশাগত রোগী, আহত বা নিহতের তালিকা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
আমাদের দেশে মোট শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ কোটি। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে অনিশ্চিত জীবনের পথে ঠেলে দিয়ে জাতীয় উন্নয়ন তথা টেকসই উন্নয়ন কখনও সম্ভব নয়। তাই জাতীয় সার্থে শ্রমিকের এই অনিশ্চিত জীবনের অবসান হওয়া জরুরি। এজন্য শ্রম নীতি, যুগোপযোগী শ্রম আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ সহ সমগ্র বিশ্বের জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশ হচ্ছে শ্রমিক সমাজ। তাই শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই মানব অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
লেখক : শ্রম আইন বিশ্লেষক ও সংগঠক টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅ্যাডভোকেট কামরুন নাহার বেগম : নারী সমাজের প্রেরণার উৎস
পরবর্তী নিবন্ধরাঙামাটির মগবানে ভোটগ্রহণ আজ