‘আমি রোগী হয়ে দেখেছি, ঘুরে দেখেছি। আমাদের নার্সিং যেন আমাদের সমাজের জন্য একটি অসম্মানজনক পেশা। আমি বুঝতে পারি না এ সমাজ কি করে বাঁচবে। একটা মেয়ে দেশের খাতিরে নার্সের কাজ করছে তার সম্মান হবেনা আর ভালো কাপড় চোপড় পরে যারা ঘুরে বেড়াবে তার সম্মান হবে অনেক উচ্চে, চেয়ারখানা তাকেই দেয়া হবে। এরও একটা মান থাকতে হবে। আমি ডাক্তার সাহেবদের সাথে পরামর্শ করেছিলাম যে, আপনারা আমাকে একটা প্ল্যান দেন যাতে আইএ পাশ এবং গ্রেজুয়েট মেয়েরা এখানে আসতে পারে’। –জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
‘নার্সিং এর মতো একটা সেবামূলক পেশা, যে পেশাটি আমি মনে করি সব থেকে সম্মানজনক একটি পেশা। কারণ একজন অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তার সেবা করা, তার পাশে থেকে তাকে রোগমুক্ত করা– এ থেকে বড় সেবা আর কি হতে পারে’।– প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
‘আমি নিষ্ঠার সহিত সৃষ্টিকর্তার নিকট এবং সর্বসমক্ষে শপথ করছি যে, আমি পবিত্রতার সহিত জীবন যাপন করিব এবং বিশ্বস্ততার সহিত আমার কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করিব। আমি, যাহা কিছু অন্যায় ও ক্ষতিকর, তাহা থেকে নিজেকে বিরত রাখিব এবং জ্ঞাতসারে ক্ষতিকর কোন ঔষধ নিজে সেবন করিবনা, অপরকেও দেবোনা। আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে, আমার পেশার মান উন্নত রাখিব এবং আমার কর্মক্ষেত্রে যে সমস্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয় জানিতে পারিব তাহার গোপনীয়তা রক্ষা করিব’। –ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের শপথ।
প্রতি বছর ১২ মে আন্তর্জাতিক নার্সেস দিবস হিসাবে উদযাপন করা হয়। ১৮২০ সালের এই দিনে আধুনিক নার্সিং সেবার অগ্রদূত ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্ম হয়েছিল। এই মহিয়সী নারীর প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসাবে তাঁর জন্মদিনটি ১৯৭৪ সাল হতে আন্তর্জাতিক নার্সেস ডে হিসাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। তাছাড়া এ দিবস উদযাপনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী নার্সদের প্রতি তাঁদের কাজের জন্য শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব নার্সেস এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে– ‘আমাদের নার্স: আমাদের ভবিষ্যৎ’। এবারের দিবসটি এসডিজি, ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ ও হেলথ ফর অল নিশ্চিতকরণের অঙ্গীকার নিয়ে উদযাপন করা হবে মর্মে সংস্থাটি জানিয়েছে। মহিয়সী নারী ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ১৮২০ সালে ১২ মে ইতালির ফ্লোরেন্সে একটি অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর নার্স হওয়ার ঝোঁক ছিল। কিন্তু তখনকার সমাজে নার্সিং কে ভালো চোখে দেখা হতোনা বিধায় তাঁর পিতা–মাতা রাজি ছিলেন না। অগত্যা তিনি গৃহ ত্যাগ করেন। ১৮৫৩ হতে ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত লন্ডনের ‘কেয়ার অব সিক জেন্টলওমেন ইনস্টিটিউট’ এর তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে কাজ করেন।
১৮৫৩ সালে শুরু হয় ক্রিমিয়ার যু্দ্ধ। ব্রিটিশ সৈন্য অবতরণ করে ক্রিমিয়াতে। উক্ত যুদ্ধে সেবা–শশ্রূষার কোন ব্যবস্থা না থাকায় আহত সৈনিকরা বর্ণনাতীত যন্ত্রণা পোহাচ্ছিল। এমন একটি অবস্থায় খবর পেয়ে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল সেখানে আহত সৈন্যদের সেবা দেয়ার জন্য যান। তখন নারীদের অবাধ স্বাধীনতা ছিলনা বিধায় যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার অনুমতি তিনি প্রথমে পাননি। তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহ দেখে সরকার পরবর্তীতে তাঁকে অনুমতি দেয়। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে আহত সৈনিকদের ব্যারাকটিকে একটি আধুনিক হাসপাতালে রূপান্তরিত করেন এবং সঙ্গিনীদের নিয়ে আহতদের পরিচর্যায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। আহত সৈনিকদের নোংরা রক্তাক্ত পোশাক ধোয়ার ব্যবস্থা নেন। আহত সৈনিকদের অবস্থা দেখার জন্য রাতের বেলা তিনি ল্যাম্প হাতে ঘুরে বেড়াতেন এবং শয্যার পাশে গিয়ে পরম মমতায় সেবা শশ্রূষা করতেন ও কুশলাদি জানতেন। দৈনিক প্রায় ২০ ঘণ্টা তিনি এরূপ সেবার কাজ করে গেছেন। ফলে তিনি আহত সৈন্যদের এমন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হলেন যে, ল্যাম্প হাতে ঘুরে দেখার সময় শরীরে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল এর ছায়া পড়লেই আহত সৈন্যরা সে ছায়ায় চুম্বন করতেন। আহত সৈন্যরা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ উপাধি দেন যা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হয়।
১৮৫৫ সালে তিনি নার্স প্রশিক্ষণের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজ শুরু করেন এবং ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত ৪৫ হাজার পাউন্ড সংগ্রহ করেন। তিনি ভারত ও ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৮৬০ সালে তিনি ‘নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অব নার্সিং’ নামে পরিচিত। তিনি ১৮৬৭ সালে ডা. এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলের সাথে যৌথভাবে নিউ ইয়র্কে চালু করেন ‘উইমেন্স মেডিকেলকলেজ’।
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল জীবনে অসংখ্য পদক ও উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৮৮৩ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া কর্তৃক ‘রয়েল রেডক্রস’ পদক প্রদান, ১৯০৭ সালে প্রথম নারী হিসাবে ‘অর্ডার অব মেরিট খেতাব’ লাভ, ১৯০৮ সালে লন্ডন নগরীর ‘অনারারী ফ্রিডম’ উপাধি। তাঁর কর্মের মাধ্যমে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল প্রমাণ করেছেন নার্সিং পেশা নয়, সেবা। পাকিস্তানী আমলে বাংলাদেশে নাসিং পেশার কোন স্বীকৃতিই ছিলনা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলেই বাংলাদেশে নার্সিং পেশার উন্নয়নের ভিত্তি রচিত হয়। সেই আমলেই বাংলাদেশ নার্সেস কাউন্সিল ও বাংলাদেশ নার্সেস এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২টি নার্সিং স্কুল তথা নার্সিং ট্রেনিং সেন্টার স্থাপিত হয়। ৩ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন নার্সিং এবং ১ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারী কোর্স চালু হয়। কিন্তু পরবর্তী সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরাচারী সরকারের আমলে নার্সিং ব্যবস্থার আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ১ম মেয়াদে ১৯৯৬ সালে নার্সিং অনুষদসহ অন্যান্য অনুষদ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নার্সিং অনুষদ (আইপিজিএমআরকে) খোলা হয়। ২য় মেয়াদে ২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকার মুগদায় নার্সিং এর উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার জন্য ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড নার্সিং এডুকেশন এন্ড রিসার্চ’ প্রতিষ্ঠা করা হয় যা হতে বর্তমানে নার্সিং এর ৬টি বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী প্রদান করা হচ্ছে।
দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আন্তরিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশ যেখানে ১টি নার্সিং সেন্টার ও ৬০০ জন নার্স নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলো, সে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৫৬ হাজার ৭৩৩ নার্স ও মিডওয়াইফ আছেন যার মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন নার্স প্রায় ৩০ হাজার জন এবং মিডওয়াইফ ১ হাজার ৫০০ জন। নার্সিং ও মিডওয়াইফারী ইনস্টিটিউটের সংখ্যা সরকারি ৪৩টি বেসরকারি ১২০ টি। নার্সিং কলেজের সংখ্যা সরকারি ১৭টি ও বেসরকারি ৬০টি। যেখানে নার্র্সিং কে একসময় নীচু দৃষ্টিতে দেখা হতো সেখানে আজ নার্সিং এ চান্সই পায়না। সর্বশেষ ১৫০০০ সিটের বিপরীতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে ৫২ হাজার শিক্ষার্থী।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা ও নার্সিং এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। বর্তমানে এই ইউনিটের অধীনে স্থাপিত জেমিসন রেডক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতালে ৩ বছর মেয়াদী নার্সিং ডিপ্লোমা কোর্স ও দেড় বছর মেয়াদী মিডওয়াইফারী কোর্স ২০১১ সাল থেকে চলমান আছে। ডিপ্লোমা কোর্সে প্রতিবছর ৫০ জন এবং মিডওয়াইফারী কোর্সে প্রতিবছর ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। দুটি কোর্সই সম্পূর্ণ আবাসিক। আবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে বর্তমানে দুটি কোর্সে বিভিন্ন বর্ষের মোট ৩০০ জন অধ্যয়নরত আছে। বর্তমানে হাসপাতাল সংলগ্ন নিজস্ব জায়গায় একটি পূর্ণাঙ্গ নার্সিং কলেজ স্থাপন করার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে যা প্রক্রিয়াধীন। জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট নার্সিং ইনস্টিটিউটকে নার্সিং কলেজ রূপান্তরের জন্য ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পাওয়া গেছে। কলেজের শিক্ষার্থীদের ক্লিনিকের প্র্যাকটিসের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জেনারেল হাসপাতালের অনুমতি পাওয়া গেছে। কলেজ হিসেবে চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিল, অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। কলেজ অনুমোদনের সবগুলো শর্ত প্রতিপালন করা হচ্ছে।
আমাদের অর্জন অনেক। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে এমডিজি’র লক্ষ্য অর্জনে আমাদের নার্স ও মিডওয়াইফের সংখ্যা আরও অনেক বাড়াতে হবে। এখন দেশে ৩ জন ডাক্তারের বিপরীতে ১ জন নার্স আছে। স্বাস্থ্য সেবার স্বীকৃত মানদণ্ড অনুসারে এটা উল্টা তথা ১ জন ডাক্তারের বিপরীতে ৩ জন নার্স লাগবে। সরকারের এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রূপকল্প ২০৪১ এর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য নার্সিং সেবা উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের সকলকেই কাজ করতে হবে।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি,
চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ।