বছর ঘুরে অল্প কয়েকদিন পর আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে শোকের মাস আগস্ট। আমাদের কাছে প্রিয়জন হারানোর মাস। এ মাসেই আমরা হারিয়েছি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাঁর সঙ্গে আমরা হারিয়েছি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবকে, হারিয়েছি বঙ্গবন্ধুর তিন পুত্র, দুই পুত্রবধূ এবং তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ জনদেরও। সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো– শিশু রাসেলকেও গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়েছিল ঘাতকরা। বিদেশে অবস্থান করছিলেন বলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন। আমাদের বাংলা সাহিত্যের বেশ কয়েকজন উজ্জ্বল নক্ষত্রকেও আমরা হারিয়েছি এই আগস্ট মাসেই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলাম, স্বাধীনতার কবি শামসুর রাহমান, বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ, সাহিত্যিক মাহবুব উল আলমসহ আরো অনেকে আছেন এ তালিকায়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল জাতির জনকের কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি বেঁচে গেলেও এই ঘটনায় নিহত হয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী, আওয়ামী লীগের সেই সময়ের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ ২৪ জন।
ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংসতম ঘটনা হলো পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট কালরাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড। পুরো পৃথিবী স্তব্ধ। নেমে আসে শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প। যাঁকে পাকিস্তানিরা মারতে পারে নি, তাঁকে নিঃশেষ করে দিলো দেশের মানুষ! বিশ্বাসঘাতকের চরম নমূনা স্থাপন করলো বাঙালি পুরো বিশ্বে। সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরীও বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ‘বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে’। অন্যদিকে, নোবেল জয়ী তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির নেতা উইলি ব্রানডিট বলেছেন, ‘মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে, তারা যেকোন জঘন্য কাজ করতে পারে।’
শোকের মাসে প্রতি বছরের মতো এবারও শৈলীর উদ্যোগে ১৫ দিনব্যাপী সেমিনার, কবিতা ও ছড়া পাঠ, আবৃত্তি ও বইমেলার আয়োজন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম একাডেমির ফয়েজ নুরনাহার মিলনায়তনে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এ আয়োজন চলবে। ১লা আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সমগ্র আয়োজনের উদ্বোধন ঘোষণা করবেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম। ১৫ দিনব্যাপী সেমিনারের বিষয়, মূল প্রবন্ধ পাঠ ও সেমিনারের সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন যাঁরা, তাঁদের নাম এখানে উল্লেখ করা হলো।
১ আগস্ট
বৃহস্পতিবার : সেমিনারের বিষয় – শিক্ষার প্রসারে বঙ্গবন্ধুর অবদান। মূল প্রবন্ধ : প্রফেসর ড. সেলিনা আখতার। সভাপতি : ড. মোহীত উল আলম। ২ আগস্ট শুক্রবার : বিষয় – বঙ্গবন্ধু ও ফোকলোর ভাবনা। মূল প্রবন্ধ : প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শেখ সাদী। সভাপতি : প্রফেসর ড. মোঃ আবুল কাসেম। ৩ আগস্ট শনিবার : বিষয় – বঙ্গবন্ধু ও স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশ। মূল প্রবন্ধ : প্রফেসর ড. উজ্জ্বল কুমার দেব। সভাপতি : প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। ৪ আগস্ট রবিবার : বিষয় – সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে বঙ্গবন্ধু। মূল প্রবন্ধ : ড. শ্যামল কান্তি দত্ত। সভাপতি : অভীক ওসমান। ৫ আগস্ট সোমবার : বিষয় – সুফিবাদ ও বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে মাইজভান্ডার দরবার শরিফের ভূমিকা। মূল প্রবন্ধ : ড. আবদুল আজিম শাহ্। সভাপতি : ড. সেলিম জাহাঙ্গীর। ৬ আগস্ট মঙ্গলবার : বিষয় – বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা। মূল প্রবন্ধ : প্রফেসর ড. উদিতি দাশ সোমা। সভাপতি : প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার। ৭ আগস্ট বুধবার : বিষয় – বঙ্গবন্ধু ও গণমাধ্যম। মূল প্রবন্ধ : প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আনোয়ার সাঈদ। সভাপতি : নাসিরুদ্দিন চৌধুরী।
৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার : বিষয় – বঙ্গবন্ধুর নাট্যচিন্তা। মূল প্রবন্ধ : ড. মো. মোরশেদুল আলম। সভাপতি : রবিউল আলম। ৯ আগস্ট শুক্রবার : বিষয় – স্বাস্থ্য–ব্যবস্থা ও চিকিৎসা–বিজ্ঞানে বঙ্গবন্ধুর অবদান। মূল প্রবন্ধ : প্রফেসর ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী। সভাপতি : প্রফেসর (ডা.) প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া। ১০ আগস্ট শনিবার : বিষয় – পার্বত্য চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু। মূল প্রবন্ধ : ড. আজাদ বুলবুল। সভাপতি : প্রফেসর রীতা দত্ত। ১১ আগস্ট রোববার : বিষয়– নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী প্রগতির অগ্রগতিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান। মূল প্রবন্ধ : ড. আনোয়ারা আলম। সভাপতি : চেমন আরা তৈয়ব। ১২ আগস্ট সোমবার : বিষয়– বাংলাদেশের শিল্প–উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা। মূল প্রবন্ধ : প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য। সভাপতি : প্রফেসর ড. আনোয়ারুল ইসলাম। ১৩ আগস্ট মঙ্গলবার : বিষয়– বঙ্গবন্ধুর প্রকৃতি ও পরিবেশচিন্তা। মূল প্রবন্ধ : ড. শামসুদ্দিন শিশির। সভাপতি : প্রফেসর ড. মহীবুল আজিজ। ১৪ আগস্ট বুধবার : বিষয়– বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছায়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। মূল প্রবন্ধ : ড. ফরিদুল আলম। সভাপতি : প্রফেসর ড. মো. সেকান্দার চৌধুরী। ১৫ই আগস্টের বিশেষ আলোচনা : ‘বাঙালির ধ্রুবতারা বঙ্গবন্ধু’। সভাপতি : অধ্যাপক এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা। সেমিনারের বিষয়– বঙ্গবন্ধু ও সমাজতত্ত্ব। মূল প্রবন্ধ : প্রফেসর ড. ওবায়দুল করিম। সভাপতি : প্রফেসর ড. অনুপম সেন।
এ উপলক্ষ্যে ‘বাঙালির ধ্রুবতারা বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক একটি সংকলন প্রকাশিত হবে। এটির প্রধান সম্পাদক ও সম্পাদক হিসেবে যথাক্রমে আমি ও জাহাঙ্গীর মিঞা দায়িত্ব পালন করছি। সংকলনে ১৫ দিনের সেমিনারের প্রবন্ধগুলো ছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ–নিবন্ধ, কবিতা, ছড়া ও নির্বাচিত গল্প স্থান পাবে। প্রায় ৫৫০ পৃষ্ঠার এ সংকলনের প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা চিনি নানাভাবে, জানি তাঁর অসংখ্য গুণের কথা। তাঁর রাজনীতি, নেতৃত্ব, উদারতা, বাগ্মিতা, দূরদর্শিতা, দেশপ্রেম, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসামপ্রায়িকতাসহ আরো অনেক গুণের কথা। তাঁর তিনটি বই প্রকাশের পর আমরা জেনেছি তাঁর লেখক সত্তার কথাও। এসব বিষয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জানানোর লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে।
বলাটা তেমন জরুরি নয় যে, আমরা দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গবন্ধুর দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করছি। কাজ করছি সনিষ্ঠ আন্তরিকতায়। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যে ক’জন সাহসী মানুষ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের পথ অনুসরণ করার নির্ভীক প্রচেষ্টা ছিলো আমাদের মধ্যে। বহু ঝড়–ঝাপটা, হুমকি ধমকির পরও আমাদের কাজের গতি ব্যাহত হয়নি। গত শতকের আশির দশকের শেষে চট্টগ্রামেই আমরা গঠন করেছিলাম ‘বঙ্গবন্ধু লেখক শিল্পী সম্মিলন পরিষদ’। এ পরিষদের উদ্যোগে আমরা একাধিক সেমিনার ও নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তখনকার সময়ে তরুণ প্রজন্মের মাঝে বঙ্গবন্ধুর চেতনা সঞ্চারের প্রয়াস নিয়েছিলাম। আমাদের উদ্যোগে নব্বই দশকের শুরুতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবিতে আয়োজিত এক সেমিনারে অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বলেছিলেন, ‘বাঙালিত্বের প্রতীক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নেই, তাঁর আদর্শ বাঙালির হৃদয়ে অনন্তকাল বহমান থাকবে। অন্ধকারের দানবরা মুজিবকে হত্যা করেছে ঠিকই, কিন্তু মানবমুক্তির প্রতিভূর মৃত্যু হয় নি’। ‘দাবাইয়া রাখতে পারবা না’ শিরোনাম নিয়ে কবিতা পাঠের আসরের আয়োজন করেছি অসংখ্যবার। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুর ওপর সম্পাদনা করেছি ‘বাঙালি’, ‘শ্রেষ্ঠ বাঙালি’, ‘দাবাইয়া রাখতে পারবা না’ ইত্যাদি সংকলন। শিশু–কিশোরদের জন্য রচনা করেছি অসংখ্য ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ। প্রকাশিত হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু তুমি অজর অমর’, ‘তীর্থভূমি’ ও ‘দশ দিগন্তে বঙ্গবন্ধু’ নামক একক গ্রন্থ। শুধু বর্তমান অনুকূল পরিবেশে নয়, প্রতিকূল পরিবেশেও আমরা আমাদের তৎপরতা চালিয়ে এসেছি সনিষ্ঠ আন্তরিকতায় ও গভীর শ্রদ্ধায়। আমরা আমাদের কাজের মাধ্যমে বারবার জানান দিতে চাই যে ‘মানবমুক্তির প্রতিভূর মৃত্যু হয় নি’।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর : ৪২২), বাংলা একাডেমি।