সাখাওয়াত হোসেন মজনু ছিলেন জাতির একজন অগ্রগণ্য লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট। তিনি ছিলেন সুবিধা বঞ্চিত মানুষের একজন সেবক। আমরা দেখি বাংলাদেশে যে‘কজন গবেষণাধর্মী লেখা, সমাজ সচেতন সমসাময়িক লেখা নিয়ে কাজ করেছেন সাখাওয়াত হোসেন মজনু তন্মধ্যে একজন এবং অন্যতম। তিনি শুধু উঁচু মাপের লেখক ছিলেন না তিনি সফল গবেষক, সফল লেখক এবং পাশাপাশি একজন সফল সংগঠকও। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা নিয়ে নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন লেখক সাখাওয়াত হোসেন মজনু। যাঁর গবেষণার কাজগুলো সংবাদ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত উঠে আসতো। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন নানা গুণ ও যোগ্যতায় ঋদ্ধ–সমৃদ্ধ একজন আলোকিত জন। বলতে গেলে উঁচুমাপের চিন্তাশীল, সমাজ নিয়ে ভাবা এবং দেশ ও জাতিকে অন্যদের কাছে গর্ব করে তুলে ধরার শক্তি ও সাহস ক‘জনেরই বা আছে। নীরবে নিভৃতে সামাজকে তিনি দিয়ে গেছেন তার বিপরীতে তিনি কিছু নিয়ে যাননি। বিশেষ করে দেশ–বিদেশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নিজের জাতি–সমপ্রদায়, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও সভ্যতাকে নানাভাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সাখাওয়াত হোসেন মজনুর ভূমিকা অনন্য। আমরা অতীত থেকে কত মানবিক গুণ ও ঐতিহ্যের অধিকারী, কিন্তু আমরা সেই গুণগুলোকে সদকাজে ব্যবহার করতে চাই না কিংবা গুণদর্শী হয়ে বিচারও করতে চাই না। আমরা চাই সব সময় অন্যের ত্রুটিগুলোকে নিয়ে সমাজে বিষবাষ্প ছড়াতে, অন্যকে ধরাশয়ী করতে। আমরা ব্যক্তির সুগন্ধি ছড়াতে চাই না, যত পারি মন্দ ও দুর্গন্ধ ছড়াতে চাই। আমরা অন্যের প্রশংসা করতে খুবই কার্পণ্য করি, সংকুচিত হই: অথচ অন্যকে খাটো করতে বা অন্যের দুর্নাম রটাতে কিংবা তাঁর গুণ ও গৌরবকে অসম্মান জানাতে অনেক উদার হই। বলতে গেলে দীর্ঘদিন থেকে আমাদের বেড়ে ওঠা এসব কুমানসিকতার–কুরুচিগুলো আমাদের অগ্রযাত্রার মেধা ও মননকে দারুণ কলুষিত করছে।
বর্তমান সমাজে এগুলোর ছড়াছড়ি বেশি মাত্রায় দৃশ্যমান হচ্ছে। আমরা জানি, এগুলো আমাদের জন্য সুখকর নয়। পণ্ডিত ও গুণীজনকে অমর্যাদা করা কোন উত্তম কাজ নয়, বরং গর্হিত ও নিন্দিত কাজ। কিন্তু লেখক কলামিস্ট সাখাওয়াত হোসেন মজনু সেক্ষেত্রে একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব অন্যের প্রতি তাঁর উদারতা চোখে পড়ার মতো ছিল। মানুষের কল্যাণ কাজে তিনি ছুটে যেতেন। গরীব দুঃখী মানুষের কাছে সাখাওয়াত হোসেন মজনু ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়জন। শুধু সমাজকে তাদের কষ্টের কথা বোঝানের জন্য শতাধিক লেখা গণমাধ্যমে লিখে গেছেন। তাঁর মতো এতো মানবিক ব্যক্তিত্ব সমাজে কম দেখা যায়। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃখ বেদনাময় ঘটনাগুলো মাঠপর্যায় থেকে তুলে এনে গণমাধ্যমে প্রকাশ করার জন্য তিনি রাতদিন কাজ করেছেন। এসব গুণী যাঁরা সমাজকে শুধু দিয়ে গেছেন তাঁদেরকে নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। যে দেশে গুণীর কদর নেই, সেই দেশে গুণী জন্মগ্রহণ করেন না। কী অসাধারণ উক্তি– একটু ভাবুন তো! সুতরাং গুণীজন দেশ ও সমাজের অলংকার, অহংকার। আমাদের ছোট্ট সমাজে এরকম গুণী ও আলোকিতজন ক‘জনই বা আছেন, একটু হিসেব করুন আমাদের ভাবা উচিৎ গুণী লোকের প্রশংসা, গুণী লোককে মর্যাদা দান এবং তাদের মর্যাদা ও প্রশংসার জায়গাগুলোকে আরও বৃহৎ পরিসরে আনতে হবে। তাঁদের মহৎ কাজগুলো প্রচার মাধ্যমে তুলে ধরা আমাদের দায়িত্ব। তা না হলে নতুন প্রজন্মকে আমরা কী বার্তা দিব। আমরা তাঁদের ভালো কাজগুলোকে তুলে ধরলেই তো তারা জানতে পারবে। এটি ধ্রুব সত্য যে, একজন গুণীকে বুঝতে হলে আরেকজন গুণীর প্রয়োজন। গুণীর কদর গুণীরাই বুঝতে পারেন, অগুণীরা নয়। আবার বলা হয়েছে, গুণী ‘গুণীজনের নিকটই সমাদৃত হন, অগুণীর কাছে নয়।’ কথাগুলো যে কত বাস্তবসম্মত এবং কত অর্থবোধক ও গুরুত্বপূর্ণ সেটা আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। ব্যাখ্যা করতে গেলে কাব্য তৈরি হবে। অতএব আমি সেই কাব্য বা মহাকাব্য তৈরি করতে চাই না। সমাজে যাঁরা গুণী ব্যক্তিত্ব আছেন তাঁরাই একমাত্র গুণী লেখক কলামিস্ট সমাজ ব্যক্তিত্ব সাখাওয়াত হোসেন মজনুর কাজগুলোকে প্রচার মাধ্যমে তুলে ধরলে তাতে নতুন প্রজন্ম এবং সমাজ উপকৃত হবে। আমরা পাঠক হিসেবে দেখেছি লেখক কলামিস্ট সাখাওয়াত হোসেন মজনু জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকা, সাময়িকীতে নিয়মিত লেখালেখিতে একজন আত্মনিবেদিত প্রাণ কলাম লেখক। গবেষণার পাশাপাশি বিবিধ বিষয়ের উপর তিনি হামেশা লিখেছেন, হরেক রকম বিষয় তাঁর লেখায় উঠে আসছে। বিভিন্ন পত্রিকা ছাড়াও নিজস্ব পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে তাঁর কলম ছিল অবিরাম। বিশেষ করে সকল বয়সের পাঠকদের জন্য লিখলেও নব প্রজন্মের জন্য লিখেছেন প্রচুর। লেখায় উঠে আসে অভিজ্ঞতা আর ব্যক্তিগত দর্শন, মতাদর্শ। আমি মনে করি সাখাওয়াত হোসেন মজনুর বিভিন্ন পত্রিকা, সাময়িকীতে লেখা প্রবন্ধগুলোর সংকলন হওয়া অতি প্রয়োজন।
তিনি সংস্কৃতি বিষয়ক, সম–সাময়িক বিষয়াদি, গণ–সচেতনতামূলক, আগামী প্রজন্মকে উৎসাহ বর্ধনমূলক প্রবন্ধ লিখে গেছেন অনেক। এ পর্যন্ত লিখিত প্রবন্ধ তিন শতাধিক। বিশেষ করে তাঁর লেখা বিশ্লেষণধর্মী এবং সমাজ সচেতনতামূলক ও আত্মোপলব্ধিগত। তাঁর মৌলিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনাও অনেক। কর্ম মানুষকে এনে দেয় সম্মান। যাপিত জীবনের কল্যাণকামী কর্মের জন্য তিনি প্রভূত সম্মান, অজস্র সম্মাননা, সংবর্ধনা, প্রীতি উপহারে ভূষিত হয়েছিলেন। এসব কিন্তু কর্মেরই মূল্যায়ন, স্বীকৃতি। যতই তিনি এই স্বীকৃতির জন্য সম্মানিত–সংগঠিত হয়েছেন ততই কর্ম প্রবণ হয়ে উঠেছেন ক্রমশ।
বলা যায়, এক্ষেত্রে বিষয়ের প্রতি গভীর মনোনিবেশের জন্য তাঁর সহধর্মিণী বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক মর্জিনা আখতার এর সার্বিক প্রণোদনা গভীর উৎসাহের কারণ। একটি সৃজনশীল ও কর্মমুখী আবহ তিনি পারিবারিকভাবে সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। আমরা সকলেই জানি, একজন কর্মবীরের মৌলিক চরিত্র হল কর্মের আদর্শ দিয়ে জগৎকে ভাবিয়ে তোলা। সেই তো সত্যিকারের মানব জীবনের সার্থকতা। তিনি জানতেন জীবন মানে সংগ্রাম। জীবন কভু ফুলের আস্তরণ নয়। আছে দুঃখ, আছে শোকের ব্যর্থতা, সীমাহীন হতাশা। সেই হতাশার অতলান্ত থেকে আশার ঝিনুক কুড়িয়ে আনার জন্য চাই অগ্নিময় জীবন। তেমনি এক সংগ্রাম মুখর জীবন ছিল লেখক কলামিস্ট সাখাওয়াত হোসেন মজনুর। আমরা চাই এই গুণী লেখক কলামিস্ট সাখাওয়াত হোসেন মজনুর সংগ্রামী জীবনের কর্মগুলো নতুন প্রজন্ম জানুক এবং জেনে অনুপ্রাণিত হোক।
লেখক: অধ্যাপক, রামু সরকারি কলেজ, কক্সবাজার।