সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্কুলে পড়ালেখার পাশাপাশি ছাত্র–ছাত্রীরা সমাজের প্রচলিত অনুশাসনগুলিও রপ্ত করে। যেমন, বড়দের সন্মান করা, ছোটদের স্নেহ–ভালবাসা দেখানো, মার্জিত আচার–আচরন, পরিস্কার–পরিচ্ছন্নতা, রুচিবোধসহ নানা বিষয়ে সাধারণ জীবনবোধ স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই পরিবার থেকে স্বাভাবিকভাবে ছেলে–মেয়েরা আয়ত্ব করে। পরিবার তার প্রথম পাঠশালা। সেই পাঠশালার প্রথম শিক্ষক মা–বাবা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার পরে সহপাঠীদের সাথে মেলামেশার মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনের আচরনগুলি ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়, পাকাপোক্ত হয়। সমাজের সচেতন মানুষরাই আগামীদিনের সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু, বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশে কোনো কোনো ছাত্র–ছাত্রী এমন কিছু আচরণ প্রদর্শন করে যেন মনেই হয় না তারা কোনো সভ্য সমাজের বাসিন্দা।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ বিগত ২১ অক্টোবর–২০২৫, স্কুলের দুই গ্রুপের মারামারিতে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী পৌরসভার আলিপুর স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র তানভীর সহপাঠীদের হামলায় গুরুতর আহত হয়। পরে স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় তাকে চমেক হাসপাতালে রেফার করেন। চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনার ৬ ঘন্টার মধ্যে পুলিশ হত্যাকান্ডে জড়িত সন্দেহে দশম শ্রেণির দুই ছাত্রসহ মোট তিন জনকে গ্রেপ্তার করে। গত ২৪ অক্টোবর রাতে নিহত তানভীরের মা মোছাম্মৎ রেহেনা আক্তার বাদী হয়ে হাটহাজারী মডেল থানায় সাত জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ৭–৮ জনকে আসামী করে মামলাটি দায়ের করেন। বাকি আসামীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে সংবাদ পত্রের মাধ্যমে জানা যায়। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে হাটহাজারী মডেল থানার ওসি মনজুর কাদের ভূঁইয়া জানান, ঘটনার কয়েকদিন আগে (১৫ অক্টোবর) আলিপুর স্কুল এন্ড কলেজে ক্লাস চলাকালে একটি ভিডিও ধারণকে কেন্দ্র করে তানভীরের সাথে দশম শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থীর বাকবিতন্ডা হয়। ঘটনার দিন সকালেও স্কুলে তাদের মধ্যে আবার বাকবিতন্ডা হয়। সেই ঘটনায় তানভীর স্কুলের প্রধানের কাছে মৌখিক অভিযোগ দেয়। কিন্তু, কাজের কাজ কিছুই হয় নাই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দিবালোকে সকলের সামনে প্রাণ দিতে হয়েছে ওমান প্রবাসী হতভাগ্য আব্দুল বারেকের নবম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে তানভীরকে। ছেলেকে হত্যার খবর পেয়ে ঘটনার দিন রাতেই ওমান থেকে গ্রামের বাড়িতে ছুটে এসেছেন আব্দুল বারেক। বুকের ধনকে শেষ দেখা দেখতে বিদেশ থেকে ছুটে এলেন বাবা। কত মর্মান্তিক, হৃদয় বিদারক ঘটনা।
নবম–দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে–মেয়েরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশে শিক্ষক–শিক্ষিকার উপস্থিতিতে এত বেপরোয়া হওয়ার কথা নয়। সামান্য ঘটনার সূত্র ধরে তর্ক–বিতর্ক, বাক–বিতন্ডা, মারামারি, জীবনহানির মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তার জন্য সকল মহলের এখন থেকে সজাগ হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ জায়গা। শিক্ষার্থীরা আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষকের নিবিড় তত্ত্বাবধানে পাঠ গ্রহণ করবে। সহপাঠক্রমিক বিভিন্ন কার্যাবলীতে অংশ নিয়ে শারীরিক এবং মানসিকভাবে বেড়ে উঠবে–এটাইতো স্বাভাবিক। কার্যত শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এসবের কিছুই অর্জন করতে পারছে না। তারা জড়িয়ে পড়ছে কিশোর অপরাধের মতো মারাত্মক ব্যাধিতে। যার করুণ পরিণতির স্বীকার হচ্ছে তানভীর এর মতো কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। এতদিন রাস্তা–ঘাটে, পাড়া মহল্লায় বখাটে ছেলেদের কিশোর অপরাধের কথা শুনেছি। কিন্তু, ক্লাসের ভিতরে সমবয়সী সহপাঠী শিক্ষার্থীরা কিশোর অপরাধে জড়ানো– এটি উদ্বেগের বিষয়, সবার জন্য অশনি সংকেত। শিক্ষক, অভিভাবক, ম্যানেজিং কমিটিসহ স্টেক হোল্ডারদের কেউ এর দায় এড়াতে পারে না।
স্কুল পর্যায়ে কিশোর অপরাধ প্রশমনে কিছু কার্যক্রমের কথা এখানে উল্লেখ করা হলঃ ১. স্কুলে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা। এজন্য প্রতি ক্লাসে না হলেও প্রথম এবং শেষ ঘন্টায় রোল কল করা। এর মাধ্যমে বিনানুমতিতে কোনো শিক্ষার্থী পালিয়ে গেল কিনা তা জানা যাবে। ২. শিক্ষার্থীদের ক্লাসমূখীকরণে আনন্দদায়ক পাঠদান নিশ্চিত করা। পাঠকে প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় করার দায়িত্ব শিক্ষকের। ৩. শিক্ষায় আইসিটির ব্যবহার নিশ্চিত করা। যেমন, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, স্মার্ট বোর্ড, ছবি ও ভিডিও ক্লাস রুমকে জীবন্ত করে তোলে। অবশ্য এর ব্যবহারে শিক্ষককে আগ্রহী ও দক্ষ হওয়া দরকার। ৪. মাঝে–মধ্যে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে কাউন্সেলিং দেয়া। এব্যাপারে কাউন্সেলিং বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো যায়। এটি শিক্ষার্থীদের অপরাধ জগত থেকে দুরে রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। ৫. প্রতিষ্ঠান প্রধানের সাথে সহকর্মী শিক্ষক–কর্মচারীদের মধ্যে সু–সম্পর্ক বজায় রাখা। একই পরিবারের সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা করা। ৬. অভিভাবকদের প্রতিনিধি হিসেবে ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। স্কুল টাইম এর আগে–পরে শিক্ষার্থীরা কোনো অসামাজিক কার্যকলাপ তথা অপরাধ জগতে জড়িত হচ্ছে কিনা কমিটির সদস্যদের এ বিষয়গুলি দেখ–ভাল করা উচিত। ৭. সরকারি নিয়মে গঠিত হওয়া প্যারেন্টস–টিচার্চ কমিটি গুলোর কার্যক্রম কাগজে–কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে সক্রিয় করা উচিত। প্রতি তিন মাস অন্তর বা আরও কম সময়ের ব্যবধানে অভিভাবক–শিক্ষক–ম্যানেজিং কমিটির ত্রিপক্ষীয় মত বিনিময় সভা করা উচিত। ৮. রাজনৈতিক কোনো মতাদর্শে কোমলমতি স্কুল–শিক্ষার্থীরা যেন প্রভাবিত হতে না পারে তার জন্য অভিভাবকদের সচেতন থাকা প্রয়োজন। ৯. স্থানীয় সামাজিক কোনো বিরোধ এর প্রতিক্রিয়া যেন স্কুলের চলমান কার্যক্রমের বিঘ্ন না ঘটায়। ১০. শিক্ষা সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিয়মিত তদারকি চলমান রাখা। ১১. পড়ালেখার পাশাপাশি শরীরচর্চা এবং বিভিন্ন খেলাধূলায় শিক্ষার্থীদের নিয়মিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
বর্ণিত ঘটনাটি ক্লাসে ভিডিওধারণকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়েছিল। স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের হাতে কেনইবা ভিডিওধারণ করার মতো ডিভাইস থাকবে–বিষয়টি স্পষ্ট নয়। স্কুলে মোবাইল ডিভাইস ব্যবহারে সরকারি কোনো সুস্পষ্ট বিধি–নিষেধ না থাকলেও প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (স্কুল পর্যায়ে) সেটি যে প্রকারের মোবাইল ডিভাইস হউক না কেন তা ব্যবহারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকা প্রয়োজন। প্রচলিত প্রাইভেট বা কোচিং সেন্টারগুলো থেকেও কিশোর অপরাধ সংগঠিত হওয়ার সুযোগ থাকে। সেখানে সমবয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক সময় ছোট বাক–বিতন্ডা থেকে অনভিপ্রেত বড় ঘটনা ঘটে যেতে পারে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান এমন হওয়া উচিত, যেন প্রাইভেট টিউটর বা নোট–গাইড বইয়ের সাহায্য না লাগে। এতে ব্যক্তি পর্যায়ে শিক্ষা ব্যয় হ্রাস পাবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষা বাজেট বাড়িয়ে হলেও অন্তত স্কুল পর্যায়ে ব্যক্তি খাতের খরচ কমানো উচিত। পরিশেষে স্কুল পর্যায়ের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাবান্ধব এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে যাতে কিশোর অপরাধ সৃষ্টি হওয়ার সকল পথ বন্ধ হয়।
লেখক : প্রধান শিক্ষক, উরকিরচর উচ্চ বিদ্যালয়, রাউজান, চট্টগ্রাম।









