মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম একটি হলো বাসস্থান তথা মাথা গোঁজার ঠিকানা। আমাদের দেশ নদী মাতৃক দেশ। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের দেশে প্রতি বছর কোনো না কোনো নদীতে ভাঙন লেগেই থাকে। তার ওপর দেশের একটি বিরাট অংশ জুড়ে আছে সমুদ্র উপকূল। সেখানেও ভাঙন খুব একটা কম নয়। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশে ২২টি জেলায় ৫৪টি ভাঙন প্রবণ এলাকা রয়েছে। এসব এলাকায় প্রতি বছর প্রায় ছয় হাজার হেক্টর এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি আর ফসলের জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। এসব বাড়িভিটে হারানো মানুষ এক সময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে দেশের বড় বড় শহরে। কারও ঠাঁই হয় ফুটপাতে, রেল ইস্টিশনে, বস্তি এলাকায় অথবা কোনো পাহাড়ি জনপদে দুর্গম এলাকায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৯ বছর পার হতে চললেও এই নিয়ে আজকের প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনার মতো আগে কেউ এমনভাবে ভাবেননি। আর ভাববেনই বা কেন? স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো দল জনগণের কাতার থেকে উঠে আসেনি। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর বিএনপি নামে যে দলটি ক্ষমতায় আসে তাদের জন্ম হয়েছিল সেনাছাউনিতে। ফলে তাদের শৈশব কৈশোর কেটেছে আলালের ঘরের দুলাল হয়ে। এ কারণে তাদের যেমন প্রসববেদনা সইতে হয়নি, তেমনি নিতে হয়নি তৃণমূলের মানুষের খবর। সুটেট-বুটেট এসব নেতারা কোদাল হাতে খাল কাটতে নামলেও আমজনতার তাদের মতলব বুঝতে খুব একটা সময় লাগেনি। জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ এর পর ক্ষমতাসীন হন আরেক জেনারেল। তিনিও দল গঠন করেন তাঁর পূর্বসূরির মতো একই কায়দায়। পার্থক্য শুধু প্রথমজন কবি ছিলেন না– দ্বিতীয়জন তাই ছিলেন। তিনি কবিতা লিখে আর গান গেয়ে বন্যার পানিতে সুটেট-বুটেট নেমে মানুষের মন জয়ের প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও আমগো ছাওয়াল এর সহানুভূতি ছাড়া আর কোথাও সুবিধা করতে পারেননি। কারণ এদেশের মানুষ রতন চেনে। তারা কখনো প্রকৃত রতন চিনতে ভুল করেন না। আর তাই বঙ্গবন্ধুর পর বাংলাদেশের মানুষ যাঁকে সবচে’ আপন বলে হৃদয়ের কোটরে জায়গা দিয়েছেন তিনি শেখ হাসিনা। কারণ শেখ হাসিনাই একমাত্র নেতা যিনি ষোল কোটি মানুষের হৃদস্পন্দন বুঝতে পারেন। তাই তাঁর প্রতিটি কর্মসূচি জনগণের অনুকূলের–জনগণবান্ধব।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজন্ম স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলার। কিন্তু ১৯৭৫ সালের নির্মম হত্যাকাণ্ড তাঁর সেই স্বপ্নপূরণ থমকে পড়ে। তারপর দীর্ঘ একুশ বছর যারা সরকারে ছিলেন তারা কেউ দেশকে গড়ার বদলে কীভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় তারই মহড়া দিতে দিতে এক সময় ছিটকে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে এখন কাজ করে যাচ্ছে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া ও রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার অঙ্গীকার নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল। তৃতীয় মেয়াদে ২০১৪ সালে সরকার গঠনের পর দেশের সকল মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্তি, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়কে অগ্রাধিকার প্রদান করে কাজ শুরু করে। একইসাথে জনগণের দোরগোড়ায় ডিজিটাল সেবা পৌঁছানো, নারীর ক্ষমতায়ন বাস্তবায়ন, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানো, পরিবেশ সুরক্ষা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দশটি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্দেশ্যে প্রণীত এই দশটি বিশেষ উদ্যোগের সব ক’টি উদ্যোগই এখন সাফল্যের মুখে। ২০০৬ সালে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ, ২০২১ সালের প্রারম্ভে এসে তা ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। অতি দারিদ্র্যের হার ২৪.২৩ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশ -এ। এসব উদ্যোগের মধ্যে সবচে গুরুত্বপূর্ণ, কঠিন ও ব্যয়বহুল উদ্যোগ ছিল মাথা গোঁজার ঠিকানা তথা আশ্রায়ণ। আশার কথা সেই কঠিন কাজটিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সম্পন্ন হতে চলেছে। গত ২৩ জানুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা এক ভিডিও কনফারেন্স-এর মাধ্যমে ৪৯২টি উপজেলার ৬৬ হাজার ১৮৯টি পরিবার এবং প্রায় ৪ হাজার ঠিকানাবিহীন ব্যক্তিকে উপহার দেন একটি করে মাথা গোঁজার ঠিকানা। মাথা গোঁজার ঠিকানা পেয়ে এতদিন ধরে ঘরহারা মানুষগুলো আবেগে আপ্লুত ও আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। তাদের কেউ কেউ গণমাধ্যমের সম্মুখে তাদের এতদিনকার ছন্নছাড়া জীবনের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তাদের গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বাড়ি পাওয়ার আগে এসব হতদরিদ্র মানুষগুলো আশ্রয়হীনভাবে এখানে সেখানে জীবনযাপন করে যাচ্ছিলেন। এই মানুষগুলো যখন প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে দুই শতক জমির ওপর নতুনভাবে নির্মিত একটি করে বাড়ি লাভ করেন তখন তাদের আনন্দ দেখে কে! ঐ মুহূর্ত শুধু মানুষগুলোর জন্যই অভিভূত হওয়ার বিষয় ছিল না, যারা টেলিভিশন সেটের সামনে বসে অনুষ্ঠান দেখছিলেন তাদের কাছেও বিষয়টি ছিল বিস্ময়কর। আমরা সাধারণ মানুষেরা ভাবতেই পারিনি আমাদের দেশের এতগুলো মানুষ এক সঙ্গে এতগুলো মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে। কিন্তু এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুললেন মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা। আগামী মাসে আরও ১ লাখ পরিবার নতুন ঠিকানা পাবে। এভাবে মুজিব বর্ষে এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই বছরে ৮ লাখ ৮২ হাজার পরিবারকে ঘর উপহার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার (তথ্য : সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ ক্রোড়পত্র, ৭ জানুয়ারি ২০২১)
পৃথিবীর কোনো দেশে এক সঙ্গে এত বিপুল সংখ্যক আশ্রয়হীন ও ভূমিহীন মানুষকে মাথা গোঁজার ঠিকানা দেওয়ার নজির নেই। অবশ্য গৃহহীনকে গৃহ দেওয়ার প্রথম উদ্যোগটা শুরু করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ১৯৭২ সালে নোয়াখালীর রামগতিতে ঘূর্ণিদুর্গত মানুষের জন্য গুচ্ছগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন যে, ‘তাঁর লক্ষ্য হচ্ছে সব মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা।’ বঙ্গবন্ধু একটি শোষণহীন সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সে স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এখন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। এই লক্ষ্যে তিনি ১৯৯৭ সালে প্রথম মেয়াদে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গড়ে তুলেন আশ্রয়ণ প্রকল্প। গত ২৩ জানুয়ারি ঘরের চাবি বুঝিয়ে দেওয়া উপলক্ষে আয়োজিত ভিডিও কনফারেন্সে তিনি বলেন, যখন এই মানুষগুলো এই ঘরে থাকবে তখন আমার বাবা-মার আত্মা শান্তি পাবে। লাখো শহিদের আত্মা শান্তি পাবে। কারণ এসব দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই তো ছিল আমার বাবার লক্ষ্য ( দৈনিক পূর্বদেশ, ২৪/০১/২১)
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি একমাত্র শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব এদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। কারণ তাঁর কোনো পিছুটান নেই। চাওয়ার মতো কিছুই নেই। তিনি তো সব হারিয়ে রিক্তের বেদন নিয়ে এই দেশ ও জাতিকে নতুন করে আলোকিত করার কাজে ব্রতী হয়েছেন। তাই আমাদের আশা গৃহহীনকে গৃহ দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হবেন না। এসব অসহায় মানুষেরা যাতে দুমুঠো খেতে পারে তার জন্যে প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করবেন। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণাও দিয়েছেন যে, এসব হতদরিদ্র মানুষের গৃহদানের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হবে। সেটি বাস্তবায়িত হলে আমাদের দেশের এক কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচ থেকে উঠে আসবেন। ফলে এসব নারী-পুরুষ দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে জাতীয় অর্থনীতিতেও রাখতে পারবে বিরাট ভূমিকা। শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে তাদের সন্তানরা শিক্ষাদীক্ষায় বেড়ে উঠবে এবং দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে যুক্ত হওয়ার দ্বার উন্মোচিত হবে। ফলে বাংলাদেশে থেকে অচিরেই দারিদ্র্য নামক শব্দটি রূপকথায় ঠাঁই নেবে তা জোর দিয়ে বলা যায়। আর তাই মুজিব বর্ষে মুজিব কন্যার মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ একটি চাহিদা পূরণ নিঃসন্দেহে একটি শ্রেষ্ঠতম উপহার।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক