রূপে গুণে অনন্যা বলতে যা বোঝায়, শায়লা ঠিক তাই। বিদ্যা-বুদ্ধি, ধার্মিকতা, রান্নাবান্না, ঘরকন্নায় জুড়ি মেলা ভার। সহকারী বিচারকের আসনে থেকে বছর দুই সাফল্যের সঙ্গে কাজ করার পর পারিবারিক ধারায় শিক্ষকতায় যোগ দেয়। সেখানেও সাফল্য পায়ে-পায়ে। খাটতে পারে দিনরাত নাওয়া-খাওয়া ভুলে। সাফল্য তো ধরা দেবেই। পূর্ব এশিয়ার অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিল বৃত্তি নিয়ে। পড়ার নেশা ছাড়ে না। ফিরে এসে বছর তিনেকের মাথায় পাড়ি জমায় প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলে অপূর্ব সুন্দর এক দ্বীপদেশে। এবার নেমে পড়ে পিএইচডি অভিযানে। একজন সফল মানুষের প্রতিচ্ছবি।
একটাই অপূর্ণতা (!) শায়লার; মা হতে পারেনি। ঠিক অক্ষমতা নেই কোন। এক দেবশিশু এসেছিল ওর কোলে বাহাত্তর ঘণ্টার জন্য। সে প্রায় এক দশক আগের কথা। দেবশিশুর বাবা দূরের শহরের কাজকর্ম ফেলে অনেক আগেই চলে এসেছিল হবু মায়ের দেখভালের জন্য। বিচারক মায়ের সদ্যজাত সন্তান চিকিৎসকের অদক্ষতায় পৃথিবীর চরম নিষ্ঠুরতা প্রত্যক্ষ করে ফিরে গিয়েছিল স্বর্গলোকে। ন’মাস ধরে ওর জন্য একটু একটু করে জমানো জামা-কাপড়, কাঁথা-বালিশ দেখে দেখে নির্বাক পাথর হয়ে গিয়েছিল অভাগা বাপ-মা। ওদের দুঃখে সেদিন আকাশ কেঁদেছে, কেঁদেছে বাতাস।
ধীরে ধীরে কাজে ফিরতে থাকে ওরা। আরও দুদু’টি দেবশিশু জানান দেয়, আসছি বলে। কিন্তু ওদেরও আসা হয় না মায়ের কোলে। হারিয়ে যায় ভূমিষ্ঠ হবার আগেই মাকে রক্তে ভাসিয়ে দিয়ে। কারও কোন দোষ নেই, ভুল নেই। ডাক্তার-কবিরাজ, এলোপ্যাথি- হোমিওপ্যাথি, ঝাঁড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজ সবার দ্বারে-দ্বারে ঘোরে ওরা। দেশ বিদেশ চষে ফেলে। তবু শোনা হয়না ‘মা’ ডাক, ‘বাবা’ ডাক। নিয়তির বিধান মেনে নেয় ওরা। সব ঠিকঠাক থাকলে তিন তিনটি শিশু হেসেখেলে বেড়াতো আজ ওদের ঘরজুড়ে। প্রতিবেশীর উঠোনে ঝুলানো ছোট ছোট জামা কাপড়গুলো দিনে দিনে বড় হতে থাকে। স্কুলের পোশাক ঝুলতে দেখা যায় একদিন। দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে আসে শায়লার আকাশ। খোদা না দিলে কার কি করার আছে! খোদার সঙ্গে যুদ্ধ করবে ? বুকে পাথর চাপা দিয়ে কাজে ফিরে যায় আবারও।
মা হবার সকল যন্ত্রণা পেয়েও স্বস্তি আর আনন্দটুকু পায়নি শায়লা। কষ্টগুলো বুকের গভীরে লুকিয়ে রেখে কাজে ডুবে থাকে। বন্ধুদের সঙ্গে হাসি আড্ডায় মেতে ওঠে। বঙ্গদেশের গরবিনী মায়েদের চোখে তা বেমানান লাগে। ওর সকল কৃতিত্ব আর সাফল্যের অধ্যায় চাপা দিয়ে মেতে ওঠে ব্যর্থ মাতৃত্বের আলোচনায়। কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে এর ব্যত্যয় হবার নয়। গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্য নিয়ে স্বদেশে এসেছিল কিছুদিনের জন্য। জীবনসঙ্গী পড়ে আছে বঙ্গোপসাগরের তীরে তার স্বপ্নের কাজ সমুদ্র গবেষণা নিয়ে। শায়লাকে দেখামাত্র একগাল হাসি হেসে এগিয়ে গিয়ে হাত মিলিয়ে, কেউবা আলিঙ্গন করে বলে ওঠেন ‘কোন খবর আছে’? গবেষণার খবর না, কাজের অগ্রগতির খবর না। সরাসরি জানতে চান সন্তান আসছে কিনা। পারিবারিক, সামাজিক অনুষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে রাজপথ সবখানে মুখরোচক আলোচনার বিষয়বস্তু। অতি উৎসাহী কেউ কেউ বলে ফেলেন- ক্যারিয়ারের জন্য এতো পাগল, সন্তান নিয়ে কোন পরিকল্পনা নেই! কেউ আবার বলেন, এমনিতে হচ্ছেনা, নাকি কাজের জন্য বন্ধ করে রেখেছ। মায়াকান্না করেন কেউ কেউ- আহারে দশ বারো বছর শেষ হয়ে গেল! কেউ আবার বলেন, নারীর পূর্ণতা মাতৃত্বে, সন্তান জন্ম দিতে না পারলে নারী জীবন বৃথা। কেউ আবার চলার পথে থামিয়ে দিয়ে নিজের কন্যাদের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় বারের মতো মা হবার সুসংবাদ জানিয়ে বাধিত করেন। শেষে একটু আদিখ্যেতা দেখাতে ভোলেননা- আহারে … সবই আল্লাহর ইচ্ছা।
একেই হয়তো বলে ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’, যা দিতে পারদর্শী মা জননীর দেখা বোধ করি আমাদের বঙ্গসমাজেই কেবল পাওয়া যায়। সাহিত্য- ইতিহাস- চলচ্চিত্রে যেমন মায়েদের ছবি আঁকা হয়, তা থেকে অনেক ভিন্ন, মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া আমাদের সমাজের এই গর্বিত জননীরা। এমন শুভাকাঙ্ক্ষী মন্তব্যকারীদের মাঝে গ্রামের অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত চাচী দাদি থেকে শুরু করে, শহরের প্রতিবেশী আত্মীয় অনাত্মীয়রা যেমন আছেন, তেমনি আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সহকর্মী। দূর কোন পরবাসে থিতু হওয়া অনেক ঝলমলে সফল আপা ভাবিরাও আছেন এই দলে। ওকে দেখামাত্র সবার মনে পড়ে যায়, বেচারি!- এতগুলো বছরে মা হতে পারল না – কী হবে এতো এতো ডিগ্রী বানিয়ে— বিলাপ আহাজারি না করে কেমন হেসে হেসে দিন পার করছে! জামাইটাকে একলা ফেলে রেখে ডিগ্রীর লোভে সেই কোন দক্ষিণ গোলার্ধে গিয়ে পড়ে আছে! কী শক্ত মেয়েরা বাবা! উত্তরাধিকার না থাকলে পৃথিবীতে কোন চিহ্ন থাকেনা- এমন দার্শনিক মন্তব্যও করেন কেউ কেউ।
শায়লাদের মা এক সাদাসিধে আটপৌরে গৃহবধূ। জগৎ সংসারের কোন ঝুটঝামেলায় নেই তিনি। হেঁসেল আর বই নিয়ে পড়ে থাকেন দিনরাত। শায়লাকে সান্ত্বনা দেন তিনি নিজের মতো করে- বেগম রোকেয়ার কোলেও এসেছিল দুই দুইটি দেবশিশু। কিন্তু ‘মা’ ডাক শোনা হয়নি তাঁরও। তাঁকে কি অপূর্ণ নারী বলা যায়? আমরা সবাই কী তাঁর আত্মজা নই? পৃথিবী কি ভুলে গেছে তাঁর কথা, না ভুলবে কোনদিন!