“কোনকালে একা হয়নি কো জয়ী,
পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে,
বিজয়লক্ষী নারী।”
একটা সময়ে নারীরা থাকতেন পর্দার আড়ালে। তাদের ঘরেই আবদ্ধ থাকতে হতো। নারীরা এক সময় উপেক্ষিত ছিলেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ধরে নেওয়া হতো, তারা অন্তঃপুরবাসিনীই হবেন। করবেন ঘরসংসারের কাজ। আর বাইরের জগতের লড়াই শুধু পুরুষের জন্য। সেক্ষেত্রেও নারীরা অনুপ্রেরণার উৎস বলে বিবেচিত হতেন স্বজনদের কাছে। প্রত্যেক যুগেই নারী তার মেধা, বুদ্ধি, যোগ্যতা, শ্রম এবং মমতার সংমিশ্রণে গড়ে তুলেছে ভবিষ্যতের বুনিয়াদ, জন্ম দিয়েছে নতুন নতুন ইতিহাসের। তেমনই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইলেন মাতঙ্গিনী হাজরা।
জন্ম ১৮৭০ সালে। তমলুক থেকে সামান্য দূরে হোগলা গ্রামে অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান তিনি। বাবা ঠাকুরদাস মাহাতী, মা ভগবতী দেবী। কড়া সামাজিক অনুশাসনেই দিন কাটছিল মাতঙ্গিনীর। ১৯৩১ সাল। মাতঙ্গিনী দেবী দেখলেন তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে এক শোভাযাত্রা এগিয়ে যাচ্ছে। যার মূল আহ্বায়ক গুণধর ভৌমিক নামে স্থানীয় এক কংগ্রেস নেতা। জানলার ফাঁক দিয়ে মাতঙ্গিনী দেখলেন শোভাযাত্রায় কিছু যুবতী এবং কিশোরী শঙ্খধ্বনি দিয়ে স্বাধীনতা দিবসকে আহ্বান জানাচ্ছেন। জীবন সম্পর্কে যে ধ্যান–ধারণা তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, সেটা কার্যত বদলে গেল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এই শোভাযাত্রায় তিনিও শামিল হবেন। তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে নেন মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা। মিছিল পৌঁছল কৃষ্ণগঞ্জে। সেখানে একটি সভায় স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার শপথবাক্য পাঠ করলেন। শুরু হল আরেকটি অধ্যায়।
এরপরই শুরু সংগ্রাম। দেশের জন্য লড়াই। চরকা কাটা থেকে লবণ সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ। ইংরেজবিরোধী কর্মযজ্ঞে ছিল তাঁর বিচরণ। বন্যা কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে হয়ে উঠেছিলেন “গাঁধী বুড়ি”।
মাতঙ্গিনী হাজরা হলেন সেই যুগের একজন বিপ্লবী। তিনি সে সময়ে শুধু শাসক ইংরেজদের মাথাব্যথার কারণ ছিলেন না, পুরুষ শাসিত সমাজকেও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, নারীর সাহসের কথা। সে সময় যারা দেশবাসীদের উদ্বুদ্ধ করে সচেতন করেছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন তাঁদেরই অন্যতম। দরিদ্রতার কারণে লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হন তিনি। তাই ছোটবেলায় পড়ার সুযোগ পাননি। অল্পবয়সে তার বিয়ে হয় ত্রিলোচন হাজরা নামক এক ব্যক্তির সাথে। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তিনি বিধবা হন। তার কোনো সন্তান ছিল না।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহান এই নেত্রীর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯০৫ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন তিনি, ১৯৩২ সালে অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন। একাধিকবার জেলে যেতে হয়েছে তাকে তবু তিনি হার মানেননি। ১৯০৫ সালে প্রত্যক্ষভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন মাতঙ্গিনী হাজরা। মতাদর্শের দিক থেকে তিনি ছিলেন গান্ধীবাদী নীতিতে বিশ্বাসী ।
পরবর্তীকালে সাহসের সঙ্গে তিনি ইংরেজ পুলিশের বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়ান
মাতঙ্গিনী। ১৯৩০ সালের মার্চ–এপ্রিল মাসে শুরু হয় লবণ সত্যাগ্রহ আইন অমান্য আন্দোলন। মেদিনীপুরের কাঁথিতেই প্রথম লবণ তৈরি শুরু হয়। খবর পেয়েই পুলিশ গ্রামে ঢুকে ঘর–বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। শাসকেরা চেয়েছিল লবণের অধিকার একমাত্র তাদের হাতে থাকুক। কিন্তু দেশের মানুষ চেয়েছিল লবণ তৈরিতে স্বাধীনতা। তাই আইন অমান্য আন্দোলনে মাতঙ্গিনী ঝাঁপিয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে আন্দোলন করতে গিয়ে মাতঙ্গিনী গ্রেপ্তার হন। নারী হওয়ার কারণে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কর মওকুফের দাবিতে আবারও আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। যার ফলে ছয় মাসের জন্য কারারুদ্ধ হন। এরপর পুলিশের কড়া নজরে চলে আসেন মাতঙ্গিনী।
১৯৪২ সাল, আন্দোলনে উত্তাল দেশ। সে বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ৭৩ বছর বয়সী মাতঙ্গিনী হাজরা ছয় হাজার মহিলা স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে তমলুক থানা দখলের উদ্দেশে মিছিল নিয়ে যান। শহরের উপকণ্ঠে মিছিল পৌঁছালে ব্রিটিশের পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে যাতে বিপ্লবীদের জনসমাবেশ ভেঙে যায়। কিন্তু তা হতে দেননি মাতঙ্গিনী। ফলে ইংরেজ পুলিশের গুলিতে আহত হন তিনি। তিনটি গুলি লাগে মাতঙ্গিনী হাজরার শরীরে। সেদিন জাতীয় কংগ্রেসের পতাকা হাতে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি দিতে দিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মাতঙ্গিনী।
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার স্বদেশের জন্য মাতঙ্গিনী হাজরার মৃত্যুবরণের দৃষ্টান্তটিকে সামনে রেখে মানুষকে বিপ্লবের পথে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। এই সমান্তরাল সরকারটি ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সফলভাবে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। পরে গান্ধীজির অনুরোধে এই সরকার ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করলে অনেক স্কুল, পাড়া ও রাস্তার নাম মাতঙ্গিনী হাজরার নামে উৎসর্গ করা হয়। কলকাতায় দীর্ঘ বিস্তৃত হাজরা রোড তাঁর নামেই নামকরণ হয়েছে। স্বাধীন ভারতে কলকাতার ময়দানে প্রথম যে নারীমূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছিল, সেটি ছিল মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তি। ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠনের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ২০০২ সালে ভারতের ডাকবিভাগ মাতঙ্গিনী হাজরার ছবি দেওয়া পাঁচ টাকার ডাকটিকিট চালু করে। তমলুক শহরে মহিলাদের জন্য ‘শহীদ মাতঙ্গিনী গভর্নমেন্ট কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করা হয় এই সংগ্রামীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে। তিনি সর্বদা মানবতার উদ্দেশ্য সাধনে নিয়োজিত থেকেছেন। মাতঙ্গিনী হাজরা স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
কবি কাজী নজরুল ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন–
‘সেদিন সুদূর নয়/ যেদিন ধরণি পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!’