চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষ অন্তঃপ্রাণ ছিলেন মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী। শূন্য থেকে সফলতার শীর্ষে পৌঁছালেও তাঁর জীবন ছিল সরল–সুশৃঙ্খল। ‘সেল্ফ মেইড ম্যান’ ইউসুফ চৌধুরীর অনেক বিশালও বিস্তৃত কর্মজীবন তাঁকে চট্টগ্রামের মানুষের কাছে চির স্মরণীয় করে রাখবে।
গতকাল বুধবার নগরীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা চট্টলদরদী মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর সমাজসেবায় মরণোত্তর একুশে পদক প্রাপ্তিতে আয়োজিত শ্রদ্ধায় স্মরণ অনুষ্ঠানে বক্তারা এ অভিমত ব্যক্ত করেন। বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। মানুষের প্রতি ইউসুফ চৌধুরীর গভীর মমত্ববোধ ছিল জানিয়ে মেয়র বলেন, ২০০১ সালে ফিজিক্যাল মেডিসিন সেন্টার–ট্রিটমেন্ট প্রতিষ্ঠার পর তিনি প্রায় আসতেন। তার হাঁটুর সমস্যা ছিল, থেরাপি নিতেন। অল্প দিনেই দেখলাম, চেম্বারের থেরাপিস্টকে তিনি আপন করে নেন। এত উঁচু স্তরের মানুষ হয়েও থেরাপিস্টের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ দেখে আশ্চর্য হই। তিনি বলেন, ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আবদুল্লাহ আল নোমান আর ইউসুফ চৌধুরী অনেক কষ্ট করেছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় যতদিন থাকবে, তাঁদের স্মরণ রাখা হবে। চট্টগ্রামের উন্নয়নে ইউসুফ চৌধুরী যে স্বপ্ন দেখতেন তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়ার কথা জানান মেয়র। তিনি বলেন, আসকার দীঘি, ভেলুয়ার দীঘিসহ ঐতিহাসিক জায়গাগুলোকে আরও দৃষ্টিনন্দন করতে চাই। বড় ব্যবসায়ীদের এনে চট্টগ্রামে ব্যবসা বাড়াতে চাই। বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটিকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। আমি আপনাদের পাশে থাকব।
ইউসুফ চৌধুরী ‘সেল্ফ মেইড ম্যান’ ছিলেন জানিয়ে অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, তার জীবন ছিল সততা আর নিষ্ঠায় ভরপুর। সারাজীবন তিনি অনেক কষ্ট করেছেন। সফলতাও পেয়েছেন। তার সংগ্রামী জীবন তরুণদের কাছে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
এম এ মালেক বলেন, শুধু ব্যক্তি জীবন নয়, সামাজিক কাজেও অগ্রগণ্য ছিলেন ইউসুফ চৌধুরী। পোল্ট্রি শিল্প রক্ষা, ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন তিনি। চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য তিনি অনেক সংগ্রাম করেছেন, আমরাও ছিলাম উনার সাথে।
এম এ মালেক বলেন, ইউসুফ চৌধুরী তার কর্মের কারণে আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। কিছুদিন আগে দৈনিক পূর্বকোণের এক বিশেষ ক্রোড়পত্রে ইউসুফ চৌধুরীকে নিয়ে তিনটি লেখা লিখেছেন তাঁর তিন নাতনী। এরমধ্যে ‘দাদা ছিলেন সরল–সুশৃঙ্খল মানুষ’ শিরোনামে লিখেছেন তানিতা চৌধুরী; ‘দাদা বেঁচে থাকবেন তার কর্মে, চট্টলাবাসীর হৃদয়ে’ শিরোনামে লিখেছেন জোহানা চৌধুরী এবং ‘চট্টলার নীরব অভিভাবক সময় অতিক্রম করা এক উত্তরাধিকার’ শিরোনামে লিখেছেন রানতিসা চৌধুরী। আমি মনে করি তাঁর নাতনীদের এ তিনটি লেখা কেউ পড়লে ইউসুফ চৌধুরীর পুরো জীবনী তার জানা হয়ে যাবে। বাংলাদেশের ২টি গুরুত্বপূর্ণ পদক তিনজন রাউজানবাসী পেয়েছে। এজন্য রাউজানবাসী হিসেবে আমি গর্বিত।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির স্থায়ী পরিষদের সভাপতি ও দি পূর্বকোণ লিমিটেডের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামের উন্নয়নে সৃজনশীল কাজের কারণে ইউসুফ চৌধুরী আগেই একুশে পদক পাওয়ার যোগ্য ছিলেন। দেরিতে হলেও তাকে এই পদক দেয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তার একুশে পদক চট্টগ্রামবাসীকে উৎসর্গ করছি।
পূর্বকোণের সম্পাদক ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী বলেন, সীমিত আয়ের পরেও বাবা আমাদের ভালো জায়গায় পড়াশোনা করিয়েছেন। প্রতিষ্ঠান গড়ে অনেক মানুষকে চাকরি দিয়েছেন। সমাজসেবায়ও তিনি সফলতা দেখিয়েছেন। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরেছেন। মানুষের দুর্দশা নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট করিয়েছেন। কর্তৃপক্ষের নজরে এনেছেন। যার সুফল এখনও মিলছে।
চট্টগ্রামকে, চট্টগ্রামের মানুষকে আলোকিত করার জন্য ইউসুফ চৌধুরী কাজ করে গেছেন জানিয়ে সমাজসেবায় একুশে পদক পাওয়া রফিক আহমদ বলেন, তিনি চট্টগ্রাম নিয়ে ভাবতেন। সমস্যা দেখলে তা সমাধানের চেষ্টা করতেন। ইউসুফ চৌধুরী জন্ম নিয়েছিলেন বলেই চট্টগ্রাম গর্বিত। তার মতো মানুষকে অনুসরণ, অনুকরণ আর অনুশীলন করতে হবে আমাদের।
অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু) প্রতিষ্ঠায় মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন উপাচার্য প্রফেসর ড. লুৎফুর রহমান। তিনি বলেন, সিভাসুর ইতিহাস লিখতে হলে ইউসুফ চৌধুরীকে নিয়ে লিখতে হবে। সিভাসু পরিবার তার অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
ইউসুফ চৌধুরীর কর্মকাণ্ডের সুফল এখনও মিলছে মন্তব্য করে প্রফেসর মুহাম্মদ সিকান্দর খান বলেন, তার মতো আমাদেরও প্রশ্ন করা শিখতে হবে। সরকারি সব কাজে জবাবদিহিতা আনতে কাজ করতে হবে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
ইউসুফ চৌধুরীকে নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি, পিএইচডি থিসিস, অ্যাওয়ার্ড চালুর প্রস্তাব দেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. ইমরান বিন ইউনুস। তিনি বলেন, ইউসুফ চৌধুরী একুশে পদক পাওয়ায় আমাদের সবার দায়িত্ব বেড়ে গেছে। তার কর্মকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কারণ তিনি জীবনেও ফুল ফুটিয়ে গেছেন, মরণের পরেও ফুল ফুটিয়ে যাচ্ছেন।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির কার্যনির্বাহী কমিটির মহাসচিব এইচ এম মুজিবুল হক শাকুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন, কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ ইব্রাহিম, বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির কার্যনির্বাহী সভাপতি এস এম নুরুল হক, উদ্যোক্তা সৈয়দ নাছির উদ্দিন, মহিউদ্দিন, দৈনিক ইত্তেফাক–এর ব্যুরো প্রধান সালাউদ্দিন রেজা, প্রফেসর আব্দুর রশিদ, প্রফেসর ড. সাইফুদ্দীন, ডা. মনিরুল মাওলা, ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম, নুরুল আলম প্রমুখ।