বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মাইকেল মধুসূদন দত্ত অবিস্মরণীয় প্রতিভা। কবিতা, নাটক, প্রহসন, আখ্যানকাব্য প্রভৃতি সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর বলিষ্ঠ ও সাবলিল বিচরণ বাংলা সাহিত্যে তাঁকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর কর্মকৃতী সৃষ্টি করেছে বাংলা সাহিত্যের সাথে বিশ্ব সাহিত্যের যোগসূত্র। সাহিত্যবোদ্ধাদের কাছে তিনি ‘মধু কবি’ নামে পরিচিত। মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোরের কপোতাক্ষ নদের তীরে অবস্থিত সাগরদাড়ি গ্রামে। গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক পাঠ শেষে ১৮৩৩ সালে কলকাতার হিন্দু কলেজে লেখাপড়া করেন তিনি।
এ সময় পাশ্চাত্যের মোহে এবং পাশ্চাত্য জীবনের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন। ১৯৪৮ সাল থেকে দীর্ঘদিন মাইকেল মাদ্রাজে শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। এখানে তিনি রচনা করেন ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’ নামের কাব্যটি। মাদ্রাজে জার্মান, ফরাসি, ইতালিয়ান, হিব্রু, তামিল, তেলেগু প্রভৃতি ভাষায় শিক্ষা নেন মাইকেল। ১৯৫৬ সালে ফিরে আসেন কলকাতায়। ধীরে ধীরে তাঁর বাংলা ও বাংলা ভাষার প্রতি অনুরাগ জন্মায়। আর তখন থেকেই তাঁর বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনার শুরু। ১৯৫৮-তে মাইকেল রচনা করেন নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’। এরপর একে একে ‘একেই কি বলে সভ্যতা’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নামের দুটি প্রহসন; আখ্যানকাব্য ‘তিলোত্তমাসম্ভব’, ‘বীরাঙ্গনা’; মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’; নাটক ‘পদ্মাবতী’, ‘কৃষ্ণকুমারী’ সহ আরো বহু রচনা মাইকেলকে বাংলা সাহিত্যের আসনে বিশিষ্ট সাহিত্যিক হিসেবে অধিষ্ঠিত করে। গ্রিক কবি হোমারের ‘ইলিয়াড’ অবলম্বনে মাইকেল রচনা করেন উপাখ্যান ‘হেকটর বধ’। বাংলায় চতুর্দশপদী কবিতা অর্থাৎ সনেট রচনার কৃতিত্ব মাইকেলের। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল বেদনাময় এবং নাটকীয় ঘটনাবহুল। প্রায় পুরোটা জীবনই তাঁর অর্থকষ্টে কেটেছে। এক পর্যায়ে স্বপ্নভূমি ইংল্যান্ডে গিয়েছেন এবং সেখান থেকে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফেরেন। কিন্তু অর্থাভাব দূর হয় না। কবির অনেক লেখনিতেই তাঁর অন্তর্জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়, পাওয়া যায় দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসার ব্যাকুল অনুভূতি। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রয়াত হন। উনিশ শতকে বাঙালির নবজাগরণের প্রধান কবি হিসেবে আজও তিনি অমর।