পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম সম্পর্ক, মধুরতম শব্দের নাম ‘মা’। যে শব্দের সাথে অন্য কোন শব্দের তুলনা হয় না। যে শব্দের সাথে জড়িয়ে আছে আবেগ, জড়িয়ে আছে অকৃত্রিম স্নেহ আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। আজ আমি বলবো আমার সাহসী মা’র কথা, বলবো ত্যাগী মা’র কথা। পৃথিবীতে অন্য কেউ এরকম আছে কিনা আমার জানা নেই।
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আমি। বাবা দয়ালু, প্রথিতযশা অংক এবং ইংরেজির শিক্ষক। এককালে অনেক অর্থবিত্ত ছিল আমাদের পরিবারে। এক ভয়ংকর দুঃসাহসিক ডাকাতির ঘটনায় অর্থবিত্তের সাথে ঠাকুরদাকেও হারিয়েছে আমাদের পরিবার।
ছোটকাল থেকে যতদূর শুনেছি সময়টা ছিল ১৯৬৯ সাল। চরম দুঃখের একটা দিন। মাঘের কনকনে ঠাণ্ডা আবহাওয়ার সাথে বাড়িতে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে উৎসবের আমেজ। সারাদিন মা, ঠাকুরমা এবং বাড়ির অন্যরা মিলে পিঠা বানাচ্ছে আর বিলি করছে। ঠাকুরদা ছিলেন তখনকার সময়ে স্বনামধন্য ধনী ব্যবসায়ী। সুপারি ব্যবসা দিয়ে শুরু করলেও পরে স্বর্ণের ব্যবসায় বেশ সুনাম প্রতিপত্তি অর্জন করেছেন। প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক তিনি। যাহোক, সেই পূজার দিন অনেক রাত করে পরিবারের সবাই যখন ঘুমে আচ্ছন্ন তখন হঠাৎ করে আমাদের ঘরে ডাকাত দল হানা দেয়। ডাকাতরা যখন ঘরের দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে তখন মা পরিবারের সবাইকে ছাদের ঘরে চলে যেতে বলেন। মা ঘরের বড় বৌ। মায়ের কথামত ঠাকুরমা, বাবা, কাকা, পিসিরাসহ সবাই ছাদে উঠে গেলেও ঠাকুরদা উঠেন না। তিনি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। কোনোমতেই উপরে যাবেন না। কারণ উনার কষ্টার্জিত ব্যবসার সব স্বর্ণ নিচে সিন্ধুকে সংরক্ষিত ছিল। অনেক টানাটানির পরও ঠাকুরদাকে তুলতে না পেরে সবশেষে আমার মা ছাদের ঘরে উঠে শক্ত কাঠের সিড়িটা উপরে তুলে নিয়ে ছাদের দরজাটা আটকিয়ে দেয়। এদিকে দরজা ভেঙে ডাকাতদল ঘরে ঢুকে গেলে লাঠি হাতে ঠাকুরদা তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে। ডাকাতরা ঘরে ঢুকে সিন্দুক ভেঙে সব সোনাদানা নেওয়ার পর উপরে উঠার চেষ্টা করতে লাগল। তারা বীম বেয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করলে মা ছাদের দরজার ফুটো দিয়ে এসিড নিক্ষেপ করে। ঠাকুরদা স্বর্ণের ব্যবসা করতেন বলে উপরে গ্যালন ভর্তি সোনাগলানো এসিড সংরক্ষিত ছিল। এভাবে ডাকাতদের প্রতিহত করে পুরো পরিবারকে একাই রক্ষা করেছেন আমার ‘মা’। মা যখন ডাকাতদের প্রতিহত করছেন, উপরে অন্যরা সবাই তখন ঠাকুরদার জন্য আহাজারি করছে। মা আমার ভয় না পেয়ে দৃঢ় চিত্তে সাহসিকতার সাথে পরিবারের সবাইকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সেদিন। এটা করতে গিয়ে মায়ের হাতের অনেক অংশ এসিডে নাকি পুড়েও গিয়েছিল। এসিডের আঘাত সহ্য করতে না পেরে ডাকাতদল সেদিন আধামরা হয়ে পালিয়ে বেঁচেছিল। এক ডাকাত বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আমাদের উঠানে মুখ থুবরে পড়েছিল। শোনা যায় সে ডাকাতকে অন্য ডাকাতেরা যাওয়ার সময় গুলি করে চলে যায়। তথ্য ফাঁস হওয়ার ভয়ে।
এদিকে গুলির আওয়াজ শুনে গ্রামের মানুষ ছুটে আসলে ডাকাতের গুলিতে আহত হয়ে মারা যান ঠাকুরদার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু। ডাকাতদল নির্মম তাণ্ডব চালিয়ে সব লুট করে নিয়ে চলে যাওয়ার পর রাত প্রায় আড়াইটার সময় সবাই উপর থেকে নিচে আসলে ঠাকুরদাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সবাই মেন্থল লাইট এনে ঠাকুরদাকে খুঁজছে, কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না।
ভোরে পুলিশ এসে আমাদের ঘর ঘিরে ফেলে। খুঁজতে থাকে ঠাকুরদাকে। সকাল দশটার দিকে নিচ থেকে উপরে, মানে আমাদের পাকা ঘরের ছাদে হাতে ইট ধরা অবস্থায় ঠাকুরদার গুলিবিদ্ধ লাশ আবিষ্কার করে। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। এই ঘটনায় আমার মাকে সাহসী কন্যা আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, উনার অদম্য সাহসিকতায় একটা পরিবার ডাকাতদের কবল থেকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। মাকে সাহসিকতার পুরস্কারস্বরূপ একটা বন্ধুক দিয়েছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। পরে বাবা অবশ্য সে বন্ধুক গ্রহণ করেননি। এটা ছিল আমার লড়াকু মায়ের ইতিহাস।
মায়ের জনদরদী কথা লিখতে গেলে শেষ হবে না। ছোটকাল থেকেই দেখতাম পাড়ার অনেক ছেলেমেয়ে আমার মাকে ‘মা’ ডাকে। আমরা বিরক্তবোধ করতাম, এই ভেবে যে তারা কেন আমার মাকে মা ডাকবে। পরবর্তীতে শোনতাম তাদের মা ডাকার ইতিহাস। তাদের মা বাবা কোন না কোনভাবে আমার মা‘র কাছে ঋণী। হয়তো বাচ্চাটা জন্মের সময় আমার মা আর্থিকভাবে সাহায্য করেছে। অথবা বাচ্চাটা বেড়ে উঠার পিছনে উনার সহযোগিতা আছে যেকোনোভাবে। গ্রামে আবার অনেকেই আছেন যারা আমাদের বাড়িতে বড় হয়ে স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। আমার দুই পিসির ছেলেমেয়ে আমাদের বাড়িতেই বড় হয়েছেন। উনাদের বাড়ি থেকে স্কুল অনেক দূরে বিধায়। তারাও মা ডাকতেন আমার মাকে। এভাবে গ্রামে আমার মায়ের সন্তানের অভাব ছিল না।
গ্রামে কারও বিপদে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন আমার মমতাময়ী মা। একবার গ্রামে এক তরুণ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করার উদ্দেশ্যে বিষ পান করেছিল। একমাত্র ছেলেকে বাঁচানোর জন্য ওই ছেলের বাবা হাউমাউ করে মার কাছে এসে কান্না শুরু করলে মা দৌঁড়ে ওদের বাড়িতে চলে যান। মুখের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বমি করিয়ে সেই ছেলেটার জীবন বাঁচিয়েছিল সেদিন। ছেলেটার বাবা আজীবন মাকে নিজের ছোটবোনের মত আশীর্বাদ করে গেছেন। আর একটা ঘটনা এখনও আমাকে নাড়া দিয়ে যায়। সেটা হচ্ছে গ্রামের এক তরুণ প্রেমিক ভুল বুঝে রাতে প্রেমিকাকে আক্রমণ করতে গেলে চিল্লাচিল্লিতে ওদের বাড়ির সবাই এসে ছেলেটাকে ধরে গণপিটুনি দিতে থাকে। মা গিয়ে ওই ছেলেকে রক্ষা করে।
মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহবধূ হয়ে মা আমার কিভাবে এত এত সাহায্য করতেন, আমার জানা ছিল না। নিজে না খেয়ে হলেও অন্যকে সাহায্য করা উনার চিরাচরিত স্বভাব। ঠাকুরমাকে আজীবন দেবতার মত ভক্তি করতেন। কাকা এবং পিসিরাও মাকে নিজের মায়ের মত শ্রদ্ধা করতে দেখেছি। আমাদের সবসময় বলতেন শ্বশুর– শাশুড়ি হচ্ছে তোদের আরেক মা–বাবা। তাঁদের যাতে কোনোরকম অমর্যাদা না হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বাড়ির আশেপাশে প্রায় সবার ঘর পুড়ে দিলেও আমাদের ঘরে নাকি আগুন দেয়নি, পাকিস্তানি সেনারা। তারা শুনেছে বছর দুই আগে ডাকাতদল এঘর থেকে সব লুট করে নিয়ে গেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের দুই গোলা ধান বাবা আর মা মিলে পাড়ার মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে সাহায্য করেছিল। মনে দু:খ মা‘র জন্য তেমন কিছুই করতে পারিনি। ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি মায়ের আত্মা যাতে স্বর্গবাসী হয়।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি, বোয়ালখালী
হাজী মো: নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।