মা, তুমি আমার জীবনের আলো

মোঃ মাজহারুল হক | রবিবার , ১১ মে, ২০২৫ at ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ

জীবনের শুরুটা হয়েছিল এক শান্ত, ধূলিমাখা গ্রামে। চারপাশে সবুজ মাঠ, কাঁচা রাস্তাঘাট, আর নির্ভরতার মতো ছায়া হয়ে ছিল আমার পরিবার। আমি বড় হয়েছি এমন এক পরিবেশে, যেখানে ভালোবাসা আর শাসনের ভারসাম্য বজায় রেখেছিলেন আমার বাবা ও মা। বাবা ছিলেন শৃঙ্খলার প্রতীক, আর মা ছিলেন নিঃস্বার্থ ভালোবাসার নাম। আমাদের ছয় ভাইবোনকে একত্রে গড়ে তোলার পেছনে ছিল এই দুই মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম, যার মাঝে মায়ের অবদান ছিল নিঃসন্দেহে অপরিসীম। বাবাকে আমরা অনেকটা ভয়ে ভয়েই চলতাম। তিনি ছিলেন নিয়মের মানুষ। তার কথার মধ্যেই ছিল নির্দেশ, এবং সেই নির্দেশ পালন করাই ছিল আমাদের কর্তব্য। কিন্তু মা ছিলেন আলাদা। তিনি ছিলেন আমাদের আশ্রয়, তিনি ছিলেন সেই মানুষ যার কাছে গিয়ে আমরা আমাদের ছোট ছোট দুঃখকষ্ট ভাগ করে নিতে পারতাম।

মা শুধুই একজন গৃহিণী ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষয়িত্রী, আমাদের গ্রামের মেয়েদের আরবি পড়াতেন। তাঁর জ্ঞানের পরিধি, ধৈর্য আর জীবনবোধ আমাদের প্রতিদিনের জীবনে আলো এনে দিত। তিনি খুব সচেতনভাবে আমাদের মানুষ করেছেন শুধু লেখাপড়ার দিক থেকে নয়, নীতিনৈতিকতা, সহানুভূতি, আত্মমর্যাদাবোধ সবকিছুর শিক্ষা দিয়েছেন আমাদের। সংসারের হাল যেমন ধরেছিলেন, তেমনই আমাদের জীবন গড়ার কারিগরও ছিলেন তিনি।

১৯৯৩ সালে, আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে, বাবা মারা গেলেন। সেই সময়ে আমরা সবাই শোকাহত হলেও মা আমাদের সামনে নিজের বেদনাকে প্রকাশ করেননি। তিনি একা পুরো সংসারের হাল ধরলেন। যেন নিজের কষ্টকে পাথরচাপা দিয়ে আমাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন গড়ে তুললেন। বাবার শাসনের অভাব যেন তার শাসনে পূরণ হয়ে গেল কখনো কঠোর, কখনো কোমল, কিন্তু সব সময় ভালোবাসায় মোড়ানো।

আমি যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করলাম, মা তখনও আমাকে সেই ছোট খোকাটাই ভাবতেন। যতই আমি উপার্জন করি না কেন, তিনি কখনোই মনে করতেন না যে আমি বড় হয়ে গেছি। তার কাছে আমার সব কিছুই যেন আগের মতোই ছিল। যতবারই টাকা দিতাম, তিনি তা ফেরত দিয়ে দিতেন। বলতেন, ‘তুমি কীভাবে চলবে?’ এমন মায়ের ভালোবাসার তুলনা নেই। বাড়ি ফিরলে যত রাতই হোক না কেন, মা জেগে থাকতেন। নিজ হাতে রান্না করতেন, পরিবেশন করতেন। আমি ‘মা’ বলে ডাকলেই, তিনি সাড়া দিতেন ‘হ্যাঁ রে’ বলে সেই ডাক, সেই প্রতিক্রিয়া আজও আমার কানে বাজে। আমি যেন প্রতিবার ডাক দিয়ে অতীতের কোনো এক মুহূর্তে ফিরে যাই।

২০১৯ সালের ৬ মার্চ, একটি নিঃশব্দ বিপর্যয়ের শুরু হলো। মা একটু অসুস্থ বোধ করলেন। ফোন করে বললেন, ‘মনে হয় অসুস্থ হয়ে গেছি, তাড়াতাড়ি বাড়ি আসো।’ আমি প্রথমে ভাবলাম হয়তো ঠাণ্ডা লেগেছে। ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ নিলেও মা ভালো হচ্ছিলেন না। বিকেলে আবার ফোন করে জানতে চাইলেন, ‘কতদূর এসেছো?’ পরদিন সন্ধ্যায় বাড়ি পৌঁছাতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তুমি আমাকে ঢাকা নিবে না? এটা আমার অনুরোধ।’ আমি বললাম, ‘নেব মা, এবার ক্ষমা করে দিও।’ ৮ই মার্চ, তাঁকে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। আমার বন্ধুরা, ডাক্তাররা সবাই পাশে ছিল। মনে হচ্ছিল সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যত সময় যাচ্ছিল, মায়ের অবস্থা তত খারাপ হচ্ছিল। বিকেলে তাঁকে আইসিইউতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। যাবার সময়ও তিনি সম্পূর্ণ সচেতন। বললেন, ‘চট্টগ্রামে যারা আছে, সবাইকে খবর দাও।’ এরপর সেই রাত গভীরে, ফজরের ঠিক আগে আইসিইউ থেকে ডাক্তার সাহেবের ফোন এলো ‘আপনার মা আর নেই।’ আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম। শুধু বললাম, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’। মার নিথর দেহ নিয়ে বাড়ি ফিরে মনে হচ্ছিল মা এখনো আছেন। আমি ডাকলাম, ‘মা!’ কিন্তু এবার আর কোনো সাড়া এল না। সেই মা, যিনি জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে আমার পাশে ছিলেন, আজ আর নেই।

মা, তুমি আমাদের ছায়া ছিলে, ছিলে নিরাপত্তার দেয়াল। তোমার চলে যাওয়া যেন হৃদয়ের এক টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে যাওয়ার মতো। আজও তোমাকে ভীষণ মিস করি। তোমার গন্ধ, তোমার হাতের খাবার, তোমার সাড়া সবই এখন স্মৃতি। কিন্তু সেই স্মৃতিই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। মা, আমি দোয়া করি আল্লাহ যেন তোমাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন। তুমি চিরকাল আমাদের হৃদয়ে থাকবে, ভালোবাসার অনন্ত আলো হয়ে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবসন্ত কুমার বিশ্বাস : অগ্নিযুগের সর্বকনিষ্ঠ শহীদ বিপ্লবী
পরবর্তী নিবন্ধঅতুলনীয় হয় মায়েরা