আজ মহান বিজয় দিবস, জাতির সর্বো”চ গৌরবের দিন। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ, নির্যাতনের শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জিত হয়। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। এই দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে একটি অবিস্মরণীয় দিন। যেসব কীর্তিমান মানুষের আত্মত্যাগে এই বিজয় সম্ভব হয়েছিল, বিজয়ের দিনে তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এ বিজয়কে অনিবার্য করে তুলেছিলেন, তাঁদের প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন। এবং যাঁর নেতৃত্বে আমরা পেলাম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, সেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জানাই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।
পৃথিবীর সব স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা দিবস থাকলেও বিজয় দিবস থাকে না। বাংলাদেশ সেই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী দেশ, যেটি ২৪ বছরের রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের পর রণাঙ্গনে শত্রুকে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছে।
আমরা জানি, বাঙালি জাতির ইতিহাস লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস, আত্মত্যাগের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পথ ধরেই বাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
জিন্নাহের দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক একটি অসম রাষ্ট্রকে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। শুরু হয় পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ, নির্যাতন। দিনের পর দিন বাঙালির ওপর অত্যাচার নির্যাতন ও শোষণ চালাতে থাকে পাকিস্তানি বর্বর শাসক গোষ্ঠী।
এই শাসন-শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালি একে একে গড়ে তোলে আন্দোলন-সংগ্রাম। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচনে বিজয় লাভের মধ্য দিয়ে বাঙালি চূড়ান্ত বিজয়ের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। এসব আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ও নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির যে আন্দোলন শুরু হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয়। যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে।
আমাদের স্বাধীনতার বয়স এখন ৪৯ বছর। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এটি খুব বেশি দীর্ঘ সময় না হলেও একটি জাতির উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্য একেবারে কম নয়। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, যে লক্ষ্য ও আদর্শকে সামনে রেখে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, সেই লক্ষ্য ও আদর্শ কতটা অর্জিত হয়েছে? রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, স্বাধীনতার প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল সব ধরনের অধীনতা থেকে মুক্তি এবং সমাজে গণতন্ত্র, ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা। সব নাগরিকের মৌলিক চাহিদা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে বাহাত্তরের সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন’ আমরা সেখানে কি সি’র থাকতে পেরেছি? কৃষি, শিক্ষা, স্বাস’্যসহ আর্থসামাজিক সূচকে আমরা অনেক এগিয়ে গেলেও রাজনৈতিক আদর্শ অর্জন ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে আমরা কি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পেরেছি?
প্রতি বছরই আসে ১৬ ডিসেম্বর, আসে বিজয়ের দিন। আবারও ‘বিজয় কেতন উড়ল’ দেশজুড়ে। বিজয়ের রঙে রাঙিয়ে দেশব্যাপী উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উদযাপিত হ”েছ ৪৯তম মহান বিজয় দিবস। ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের এই দিনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাঋদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার নতুন করে বজ্রকঠিন শপথ নেবে বীর বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
সারা বাংলার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের বিজয় এনেছিল। একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের মানুষ আবারও মৌলবাদীদের উত্থান রুখে দেবে। সকলের প্রত্যাশা, অসামপ্রদায়িক চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেই আদর্শের বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। একটি সুন্দর অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলা এখন মূল লক্ষ্য। সেখানে স্বাধীনতাবিরোধী কোনো অপশক্তি টিকে থাকতে পারবে না। বিজয়ী জাতি কখনোই পরাভব মানে না। বাংলাদেশ তার লক্ষ্যে অবিচল থাকবে।