আজ ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস। ১৯২০ সালের এই দিনে রাত আটটায় টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ পরিবারের আদরের ‘খোকা’। যিনি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির ‘মুজিব ভাই’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু’। তাঁর হাত ধরেই আসে বাঙালির স্বাধীনতা, জন্ম নেয় বাংলাদেশ। ৫৫ বছর বয়সে কিছু বিপথগামী সেনা কেড়ে নেন তাঁর প্রাণ। কিন্তু দেশের প্রতিটি কোনায় আজ উচ্চারিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে। মহামারি করোনার কারণে মুজিব বর্ষের ঘোষিত কর্মসূচি শেষ করতে না পারায় এর সময়সীমা ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের লক্ষ্যে সরকার ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ সময়কে মুজিব বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। মুজিব বর্ষ উদ্যাপনের লক্ষ্যে গৃহীত কর্মসূচি কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির কারণে নির্ধারিত সময়ে যথাযথভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব না হওয়ায় মুজিব বর্ষের সময়কাল গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছিল। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, সরকার মুজিব বর্ষের সময়কাল ও ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় কমিটি’ ও ‘জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি’র মেয়াদ আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত বর্ধিত ঘোষণা করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন বুননের কারিগর। বাঙালি জাতির ধ্রুবতারা। বাঙালির সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষাকে নিজের ভেতরে ধারণ করে তিনি বাঙালিকে উপহার দিয়েছেন স্বাধীনতা। বিশ্বের বুকে এঁকে দিয়েছেন নতুন মানচিত্র। তিনি শুধু একটি স্বাধীন দেশ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেননি। জাতি গঠনেও রেখে গেছেন অনন্য অবদান।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন দীর্ঘমেয়াদি অর্থনীতি মুক্তির প্রবর্তক। পরনির্ভরশীলতা ত্যাগ করে নিজস্ব সম্পদের ওপরে দেশকে শক্ত করে দাঁড় করানো ছিলো বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক মূল আদর্শ ও লক্ষ্য। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে বঙ্গবন্ধুর সামনে ছিলো ভগ্ন দশায় থাকা অবকাঠামো, বিধ্বস্ত অর্থনীতি ও কঠিন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। সব জটিল চ্যালেঞ্জ সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেন বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সুনিপুুণভাবে। এ সময় তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের সব নীতি ছিল দেশের মানুষের স্বার্থকে ঘিরে। বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গে প্রশাসনকে পরিচালিত করতে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারের ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করার নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাইরে নানা চক্রান্ত তাঁকে বিচলিত করার চেষ্টা চলছিলো। পরাক্রমশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে আসছিল। তবু তিনি উন্নত মস্তিষ্কে সব বাধা অতিক্রম করছিলেন। আত্মমর্যাদাশীল নেতা ও বাঙালির শ্রেষ্ঠতম প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ছিলেন উন্নতশির। আন্তর্জাতিক সহায়তার নামে করুণাকে তিনি উপেক্ষা করেছেন সবিনয়ে। ১৯৭৩ সালে বিশ্ব ব্যাংকের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট পিটার কারগিল এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘দাতাদের কাছ থেকে সহায়তা না নিলে বাংলাদেশের জনগণ কী খাবে’। বঙ্গবন্ধু তখন তাঁকে বাড়ির জানালার কাছে গিয়ে বাইরে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ‘আপনি বাইরে কী দেখতে পাচ্ছেন?’ কারগিল বলেছিলেন- ‘সবুজ ঘাসের একটি সুন্দর উঠোন’। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘যদি আপনারা কোনো ধরনের সহায়তা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তবে আমার জনগণ এগুলো খাবে’। এমনি আত্মমর্যাদাশীল এক নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পরবর্তী সময়ে অবশ্য অনেক শিথিল শর্তে ওই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়েছিল বলে জানা যায়।
আমরা স্মরণ করতে পারি ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ঐতিহাসিক মহাকাব্যিক ভাষণটি দিয়েছিলেন, তার কথা। বলেছিলেন : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’। তাঁর ভাষণের মূল কথাটি ছিল মুক্তি। এ মুক্তি শব্দটির ব্যঞ্জনা ও ব্যাপকতা ছিল বহুমাত্রিক। এই শব্দে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, তিনি যে রাষ্ট্রচিন্তা করতেন তার মূলে ছিল সাধারণ মানুষ ও তাদের কল্যাণ। তাঁর মতো করে তিনি তাই বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার কথা বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতে যুক্ত করেছিলেন। গণমানুষের সেই অর্থনৈতিক মুক্তিতে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা অবিস্মরণীয়।
বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের আজকের বাংলাদেশ। আমাদের স্বপ্ন ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জন। আজকের নেতৃত্ব সেই পথেই অগ্রসরমান।