বাংলাদেশে সামপ্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় কিউলেক্স মশার সংখ্যা চার গুণ হয়ে গেছে। সঙ্গে বেড়েছে মশাবাহিত রোগবালাইয়ের পরিমাণ ও মানুষের ভোগান্তি। ফলে মশা থেকে বাঁচতে নানা ধরনের মশা বিতাড়নের পণ্যের ব্যবহারও বাড়ছে। এর মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের কয়েল, স্প্রে ও ক্রিম জাতীয় পণ্য।
বাজারে এখন এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা। চাহিদার সাথে সাথে পণ্যের কার্যকারিতা নিয়ে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনেও দেখা যায় প্রতিযোগিতা। দেশে মশার ওষুধ বাজারজাত করার আগে প্রত্যেকটি পণ্যের জন্য কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের প্লান্ট প্রটেকশন উইং থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। সংস্থাটি বলছে, দেশে এই মুহূর্তে ৪৫০টির বেশি ব্র্যান্ডের বিভিন্ন ধরনের মশার ওষুধ পাওয়া যায়। প্রায় ৮০টির মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এগুলো তৈরি ও আমদানি করে বাজারজাত হচ্ছে। কিন্তু এত পণ্যের ভিড়ে কিভাবে বুঝবেন, কোন পণ্যটি মানব স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক কবিরুল বাশার বলেন, যদি দেখা যায় মশা তাড়ানোর জন্য ব্যবহার হওয়া কোনো কয়েল, স্প্রে, ক্রিম, বিশেষ ব্যাট বা মশারি ব্যবহারে ঘরের মশা মরে যায়, সাথে ঘরের অন্যান্য পতঙ্গ যেমন টিকটিকি বা অন্য ছোট পোকা মারা যায়, তাহলে বুঝতে হবে সেটি মানব শরীরের জন্য চূড়ান্ত ক্ষতিকর।
রিপেলেন্টের কাজ মশা তাড়ানো। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক সময় পণ্যের বিজ্ঞাপনে বলা হয়, মশা কার্যকরভাবে মেরে ফেলবে। এর মানে ওই পণ্যে অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। সেটি মানবশরীরের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর।
তিনি বলেন, এ ধরনের ওষুধে যেমন মানবদেহের ক্ষতি হয়, তেমনি মশার ওপর নির্ভরশীল অন্যান্য প্রাণীকুলও বিপন্ন হয়। যেকোনো কীটনাশকের মধ্যে ব্যবহারভেদে দুই মাত্রার রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এর একটি হচ্ছে অ্যাগ্রিকালচারাল গ্রেড, মানে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত মাত্রা। অন্যটি হচ্ছে পাবলিক হেলথ গ্রেড অর্থাৎ এটি মানব শরীরের সংস্পর্শে আসার জন্য নির্ধারিত মাত্রা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পাবলিক হেলথ গ্রেডে ব্যবহারের জন্য রাসায়নিকের মাত্রা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, যাতে কম প্রভাব পড়ে বা সহনশীল মাত্রার মধ্যে থাকে। কয়েল, স্প্রে বা যেকোনো ওষুধের উপাদানের মধ্যে ব্যবহৃত কীটনাশকের মধ্যে পার্থক্য থাকে, একেক কোম্পানি কীটনাশকের একেক ধরনের জেনেরিক ব্যবহার করে। ফলে একটির সঙ্গে আরেকটির ফলাফলে পার্থক্য থাকে।
একেক ধরনের মশার জন্য একেক ধরনের ওষুধ রয়েছে। পূর্ণবয়স্ক মশা তাড়াতে যে ওষুধ লাগবে, লার্ভা নিধনে সেই ওষুধ কাজ করবে না। দেশে সাধারণত মশার কয়েল ও স্প্রেতে পারমেথ্রিন, বায়েঅ্যালোথ্রিন, টেট্রাথ্রিন, ডেল্ট্রামেথ্রিন, ইমিপোথ্রিননের মতো রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এছাড়া মশার কয়েল বা স্প্রে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তার মাত্রা সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা আছে। যেমন মশা তাড়ানোর স্প্রে ঘরে ছিটানোর পর সে ঘরে পরবর্তী ২০ মিনিট মানুষকে থাকতে নিষেধ করা হয়। কারণ ওই স্প্রেতে ছড়ানো কীটনাশকের ড্রপলেটস মাটিতে নেমে আসতে ২০ মিনিট সময় লাগবে। ফলে তখন সেখানে মানুষ থাকলে তিনি সরাসরি কীটনাশকের সংস্পর্শে আসবেন, যা তার জন্য ক্ষতিকর।
কবিরুল বাশার বলেন, নিরাপদ থাকার জন্য মশা মারার ব্যবহার বিধিও জানতে হবে ও মানতে হবে। অভিযোগ আছে, অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়ম মেনে মশার ওষুধ বানায় না। এর ফলে কয়েল, স্প্রে বা অন্য কোনো রিপেলেন্ট পণ্যে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক থাকে। সে কারণে কয়েল বা স্প্রের ফলে মানুষের শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি হয়। অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন, মশার কয়েল স্প্রের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর।
মশা তাড়ানোর প্রাকৃতিক পদ্ধতি : বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন মশা তাড়াতে কয়েল বা স্প্রে ব্যবহার না করে প্রাকৃতিক উপায়ে চেষ্টা করা যেতে পারে। ১. নিমে মশা তাড়ানোর বিশেষ গুণ রয়েছে। ত্বকে নিম তেল লাগালে মশা কাছে আসবে না। ২. মশা কর্পূরের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে কর্পূর দিলে মশা পালিয়ে যায়। ৩. লেবু ও লবঙ্গ একসঙ্গে রেখে দিলে ঘরে মশা থাকে না বলে প্রচলিত আছে। এগুলো জানালায় রাখলে মশা ঘরে ঢুকতে পারবে না। ৪. ব্যবহৃত চা পাতা ফেলে না দিয়ে রোদে শুকিয়ে সেটা জ্বালালে চা পাতার ধোঁয়ায় ঘরের সব মশা-মাছি পালিয়ে যাবে। কিন্তু এতে শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি হবে না।