চট্টগ্রাম নগরীর বাসিন্দারা মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। আজাদীসহ বিভিন্ন পত্রিকায় অনেক প্রতিবেদনও এ সম্পর্কে সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে। এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না, মশার উপদ্রব বাড়ে তখনই, যখন মশক নিধন কার্যক্রম থাকে না। নগরজুড়ে এখন মশার যন্ত্রণা এতটাই বেড়ে গেছে যে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে খারাপ। মশার এমন উপদ্রবে এর আগে কখনো ভুগতে হয়নি নগরবাসীকে। অনেক বাসায় দিনদুপুরেও মশারি টানিয়ে রাখতে হচ্ছে ক্ষুদ্র এ প্রাণীটির উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে।
চলছে কোভিড-১৯ মহামারির দাপট। এর মধ্যে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ অসময়ে। সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর মূল মৌসুম শেষ হলেও এখনো উল্লেখযোগ্যহারে ডেঙ্গু রোগী পাওয়ার খবর মিলছে। মূলত বর্ষা মৌসুমের শেষে কয়েক দিন থেমে থেমে বৃষ্টিপাতের কারণে এডিস মশার লার্ভা বংশ বিস্তার ও বৃদ্ধির সুযোগ পেয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বসতবাড়ি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এয়ারকন্ডিশনার, গাড়ির ব্যবহৃত টায়ার, চিপসের প্যাকেট, ডাবের খোসা, ফুলের টব, পরিত্যক্ত মাটির পাত্র, রঙের কৌটা, বালতি, নির্মাণাধীন ভবন এসব জায়গায় ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে সবচেয়ে বেশি। কাজেই ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধে সম্ভাব্য আবাসস্থল ও উৎস ধ্বংসের বিকল্প নেই। সিটি কর্পোরেশনের তরফে আগে থেকে পদক্ষেপ নেয়ায় গত বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত সংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও যে কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শৈথিল্যে তা বড় জনস্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিতে পারে। দেখা যাচ্ছে, যখনই এডিস মশার লার্ভার উৎপত্তিস্থল শনাক্তের অভিযানে ভাটা পড়ছে, তখনই ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে। তাই মশক নিধন বিরোধী অভিযান বন্ধ করা যাবে না। নিয়মিত বিরতিতে লার্ভার উৎস ধ্বংসের কার্যক্রম চালাতে হবে। চিকিৎসকের মতে, করোনার মতো ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ এবং দুটি রোগের লক্ষণও একই। এজন্য একই সময়ে দুই ধরনের ভাইরাসের প্রকোপ চললে বড় ভয়ের কারণ রয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, করোনা আতঙ্ক ও সরকারি আস্থাহীনতার কারণে রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগীরা সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি চিকিৎসা সেবামুখী হচ্ছেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ডেঙ্গু রোগীদের ৬২ শতাংশই ভর্তি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। এক্ষেত্রে আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান বেসরকারি চিকিৎসা সেবা নিতে পারলেও দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর গন্তব্য ঠিকই থাকছে, সরকারি হাসপাতালগুলো। এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ চলমান থাকায় বিশেষত দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য আন্তঃহাসপাতালগত সমন্বয় এবং ব্যবস্থাপনাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একদল গবেষকের গবেষণায় প্রমাণ মিলছে, মাত্র দুই মিলি পানিতে এডিস মশার লার্ভা বংশ বিস্তার করতে সক্ষম। তাই ধোয়া ছিটিয়ে কোনো লাভ নেই, বরং অধিকতর বৈজ্ঞানিক উপায়ে মশার বংশবিস্তার কীভাবে রোধ করা যায়, সেটি ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে কার্যকর পন্থা হিসেবে এডিশ মশা বন্ধ্যা করণের কথা বলা হচ্ছে। মূলত স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক পদ্ধতি (এসাআইটি) এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি। চীন এ পদ্ধতি ব্যবহার করে সফল হয়েছে। দেশে এ বিষয়ে প্রায়োগিক গবেষণা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। এটিকে দ্রুততার সঙ্গে কীভাবে মাঠ পর্যায়ে এগিয়ে নেয়া যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী কার্যকর পন্থাটি বিস্তৃত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আপাতত প্রতিরোধেই জোর দিতে হবে। সরকারি পদক্ষেপের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ে বাড়ির চারপাশে পরিষ্কার রাখা এবং পানি জমতে পারে এমন জায়গাগুলোয় দুদিনের বেশি পানি জমতে না দেওয়ার মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সাধারণ মানুষের সচেতনতা ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণ করে। আগের চেয়ে মানুষের সচেতনতা বেড়েছে। এটা ইতিবাচক। এখন নিজের চারপাশটা পরিচ্ছন্ন রাখার কাজটিকে আমাদের প্রাত্যহিক অভ্যাসে পরিণত করতে হবে বৈকি।
সিটি করপোরেশন সারা বছর নিয়মিতভাবে মশক নিধন কার্যক্রম চালিয়ে গেলে মশার উপদ্রব এমন মাত্রায় বেড়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। মশক নিধন কার্যক্রমে শিথিলতা দেখালে অচিরেই আমরা আবারও বড় বিপদের মুখোমুখি হতে পারি।