সুপেয় ও ব্যবহার্য পানি নিয়ে গোটা বিশ্বে বিশেষ ধরনের জ্বালা কাজ করছে। হাহাকার আছে, হা–পিত্যেশ আছে। আছে শিক্ষা–প্রশিক্ষণ–গবেষণা। বিশুদ্ধ পানিপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা–অনিশ্চয়তা নিয়ে ক্ষোভ–সংক্ষোভ আছে। প্রাতিষ্ঠানিক কিছু তথ্য পানিবঞ্চিত মানুষজনকে খেপিয়ে দেওয়ার মতো বোধ জাগিয়ে দেয়। জাতিসংঘের ‘বিশ্ব পানি উন্নয়ন’ প্রতিবেদন– ২০২৩ থেকে জানা যায়, সারা বিশ্বে প্রায় ৩৫০ কোটি মানুষ বছরে অন্তত এক মাস উত্তরহীন তীব্র পানি সংকটে পড়ে। খেদোক্তি সৃষ্টি করে ৪০ শতাংশ মানুষ দূষিত পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জীবন্ত এই তথ্যকে আমলে নিয়ে দেখেছে পানিবাহিত রোগে বছরে গড়ে ২০ লাখ মানুষ মারা যায়। বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের সুযোগ পেলে, সচেতন হলে এই সংখ্যা অনেক কমে যাবে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বিশ্লেষণী এই তথ্য বিশ্ব প্রেক্ষাপটের। বাংলাদেশের নিজস্ব তথ্য আরো বেশি মর্মান্তিক। নির্মম, হৃদয়বিদারক। এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্সের এক গবেষণায় দেখা গেছে বর্তমানে আমাদের দেশের ৪৪ শতাংশ বা ৮ কোটি মানুষ নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে জীবনের রুক্ষ সময় পার করছে। এইসবের বিপরীতে শান্তি–তৃপ্তি ও স্বস্তিদায়ক কিছু অভিনব তথ্যও দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ কর্তৃক প্রকাশিত পানির ইতিহাস সম্পর্কিত কিছু উজ্জ্বল তথ্য আমাদের প্রাণিত করে। আস্বস্ত করে, ক্ষেত্রবিশেষে মোহিত করে। তারা হিসাব–নিকাশ করে দেখিয়েছে, বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে ব্যবহারযোগ্য পানির উৎসের কাছাকাছি রয়েছে। অথচ তা শুদ্ধতার সাথে নিরাপদভাবে ব্যবহার করতে পারছে না। দূষণ শব্দটি এখানে খুব জটিলভাবে সংকট তৈরি করে রেখেছে। ঋতুভিত্তিক, এলাকাভিত্তিক, অঞ্চলভেদে এই দূষণের মাত্রা আরো তীব্র হয়। স্বভাবতই গ্রীষ্মকাল মানুষের প্রাত্যাহিক জীবনসংগ্রামের সুখ–দুঃখের সঙ্গী হয়। ব্যবহারযোগ্য ভূ–গর্ভস্থ পানির স্তর অনেক বেশি নেমে যায়। উত্তোলন অযোগ্য হয়ে পরে। আর বর্ষাকাল আলাদা–অন্যরকম সংকট সৃষ্টি করে। স্বাভাবিক পানি প্রবাহে জীবাণু সংক্রমিত করছে। নলকূপ, নদী, পুকুর, খাল বিলের পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে গুণিতক হয়। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় ঘোরতর সংকট সৃষ্টি করে।
ইউএনডিপি এই বিষয়টি নিয়ে গ্রহণযোগ্য জরিপ চালিয়েছে। তারা উপকূলীয় এলাকায় প্রতি লিটার খাবার পানিতে ২ হাজার ৪০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা শনাক্ত করেছে। এই মাত্রার লবণাক্ততা মানবদেহের জন্য মাত্রাতিরিক্ত হুমকি। লোনাপানি, লবণাক্তপানি, স্বাদুপানি, নোংরাপানি, দুর্গন্ধযুক্ত পানি, বিশুদ্ধ পানি, ক্ষতিকর জীবাণুযুক্ত পানি ইত্যাদি যত রকম বিশ্লেষণে বিশেষায়িত করা যায় সবই প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। প্রকৃতির স্বাভাবিক–ধারাবাহিক গতিধারাকে বাধাগ্রস্ত করি আমরা। ফলে মনুষ্যসৃষ্ট দূষণের কবলে পরে জল–বায়ু–পরিবেশ–প্রতিবেশ–প্রকৃতি। এইসবের প্রভাব হয় ভয়াবহ। সারা পৃথিবীর সচেতন মানুষের মাথাব্যথার কারণ হয়– ‘জলবায়ু’। মানবসৃষ্ট কার্যকলাপের ফলে জলবায়ুর অদ্ভুত পরিবর্তন দেখছে বিশ্ববাসী। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও আবহাওয়াবিজ্ঞানীরা বলেছেন– ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী যে সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হয়েছে, তার নজির বিগত ১০০ বছরের মধ্যে ঘটেনি। এ বছরে দাবানল, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, উষ্ণতা ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নারকীয় দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছিল।
জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেলের একটি বিশেষ রিপোর্টে বিশেষ সতর্ক করে রেখেছে যে, ২১০০ সালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর খারাপ অবস্থার মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। নির্মম এই সত্য উচ্চারণ কেবল মানুষের জন্য নয়; অন্যসব জীবের জন্যও সবচেয়ে বড় হুমকি। জীববৈচিত্র্য ভারসাম্যহীন হবে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ– এর গ্লোবাল ক্লাইমেট রিঙ ইনডেঙ অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক কারণের মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ অন্যতম একটি কারণ বলে জানিয়েছে। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্লাস্টিক উদ্ভাবনের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বে ৮৩০ কোটি মেট্রিক টন প্লাস্টিক উৎপাদন করেছে মানুষ। পরিবেশ বিপর্যয়ের বোবা আর্তনাদ এই প্লাস্টিক মাত্র ৯ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়। ১২ শতাংশ পুড়িয়ে ফেলা হয়। বাকীসব আবর্জনায় পরিণত হয়। বোবা চাহনি নিয়ে সবাই আমরা দেখছি। আর জানছি বছরে ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক আবর্জনা নদী–নালা–খাল–বিল হয়ে সমুদ্রে জমা হচ্ছে। প্লাস্টিক নিয়ে একটি রিপোর্ট হতবিহ্বল হওয়ার মতো। এখন পর্যন্ত যত প্লাস্টিক স্থলভাগে আছে, তা এক জায়গায় জড়ো করলে এভারেস্টের চেয়েও সুউচ্চ হবে। এইসব নিয়ে যে শুধু হিসাবনিকাশ করা হয় তা নয়, কিছু কিছু সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক ব্যক্তি উচ্চকণ্ঠে সোচ্চার। প্রতি বছর জলবায়ু বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়। বিশ্বনেতারা অংশ নেন, আলোচনা চলে, সিদ্ধান্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্থদের স্বপ্ন বুনে দেয়। বাস্তবায়নের গতি মন্থর–অতি ধীর।
২০২৩ সালের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন আগামী ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বৈশ্বিক এই দুর্যোগ পরিস্থিতির মধ্যে আফ্রিকায় মরুভূমির নিচে সুপেয় পানির বিশাল ভাণ্ডারপ্রাপ্তির খবর ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। মরুভূমিতে পানির অভাব, অথচ মাটির নিচে লুকায়িত প্রাচীন জলাধার। বলা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভূগর্ভস্থ পানির ভাণ্ডারের অস্তিত্ব। দৃপ্তিময়ী এই বিশুদ্ধ পানি আধুনিক প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহার করে সদ্ব্যবহার করতে পারলে মরুর বুকে জাগ্রত হবে নতুন চেতনা। অবিশ্বাস্য মনে হলেও মিসর–সুদান–চাদ–লিবিয়ায় বিস্তৃত কয়েকশ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বালুর স্তুপের নিচে রয়েছে জলাধারের শক্তিশালী প্রবাহ। পানিবিজ্ঞানী ও ভূতত্ত্ববিদদের এই আবিষ্কার নাম দিয়েছেন ‘নিউবিয়ান স্যান্ডস্টোন অ্যকুইফার’। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘জীবাশ্ম’ জলাধার। কয়েক লাখ বছর আগে সেখানে পানি জমা হয়ে মাটির নিচে আটকে আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেভাবে মরুকরণ বাড়ছে সেখানের এই বিশাল জীবাশ্ম পানি মানুষ ও প্রাণীর অস্তিত্বকে উজ্জ্বীবিত করবে। প্রকৃতির বোধ এই পানি মমতামাখানো টেকসই উপায়ে ব্যবহার করতে পারলে গোটা বিশ্বের জন্য এক অনন্য উদাহরণ হবে। বিরল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হবে। আর্থিক মূল্যের বিচারে নয়, পানিপ্রাপ্তির সমঅধিকারের বিষয় ভাবনায় আর ব্যবহারযোগ্য পানি নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতির মানবিক প্রশান্তি কামনায়। বিশুদ্ধ পানির জন্য দ্বগ্ধ হৃদয়ের হাহাকার চিত্র প্রশমিত হবে। ভালোবাসা আর মমতায় গড়ে উঠবে স্বপ্নের পৃথিবী। মানবজাতিসহ বিপর্যস্ত জীববৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে বিশুদ্ধ পৃথিবী গড়ার লক্ষ্য একধাপ এগিয়ে যাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, পানিসম্পদ কৌশল বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়–চুয়েট।