১৭৮৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে স্যার উইলিয়াম জোন্স এদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসে এক নবযুগের সুচনা করেন। পরবর্তীতে মেরেডিথ পার্কার, ডেভিড লেস্টার ও উইলিয়াম কেরির মত উল্লেখযোগ্য ইংরেজরা সেই ধারাকে আরো অগ্রসর করে নেন। ১৮১৭ সারে প্রতিষ্টিত হিন্দু কলেজ থেকে বের হওয়া ইংরেজি শিক্ষিত কিছু বাঙ্গালী তরুণ এদের প্রভাবে ইংরেজী ভাষাতেই সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। উনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে এ দেশে দুই ধরনের সৃষ্টিশীল কাব্যিক ধারার সূত্রপাত হয়– যার মধ্যে একটি হলো orientalist literary stream অন্যটি হল Anglilist literary stream। প্রথমটি হল ইংল্যান্ড ও এদেশে জন্ম নেয়া মূলত ইংরেজভাষী ভারতীয়দের সাহিত্য চর্চা আরেকটি হল এদেশে জন্ম নেয়া বাংলা ভাষী ইংরেজি লেখকদের সাহিত্য চর্চার ধারা। এই দুই ধারার মূল আবহ ছিল অবশ্যই ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এ সময়েই আমরা আর্বিভূত হতে দেখি বাংলা রেনেসাঁসের অন্যতম প্রাণ পুরুষ, হেনরি লুই ডিভিয়ান ডিরোজিওকে (১৮০৯–১৮৩১), যিনি বাংলাভাষী ইংরেজি লেখক ও সাহিত্যিকদের বিশেষ করে হিন্দু কলেজের তাঁর ছাত্রদের একটি সংস্কারমুক্ত পুরো প্রজন্মকে প্রাণিত করার নেপথ্য শিক্ষক হিসাবে এদেশের বিদগ্ধ সমাজে সুপরিচিত। ডিরোজিও’র কাব্য ভাবনাকে প্রভাবিত করেছে প্রধানত অতিন্দ্রীয় কল্পলোকের উর্ধ্বে সর্বমানবীয় মূল্যবোধ, ভারতীয় জীবনবোধ ও ইউরোপীয় যুক্তিবাদ।
ডিরোজিও’র ভাব শিষ্য হিসাবে সেদিন আমরা এক ঝাঁক প্রতিভাদীপ্ত তরুণকে পাই যাঁরা সমস্ত অনাচার, সংস্কারের অভ্রভেদী সামাজিক বাতাবরণ ছেড়ে বেরিয়ে এসে ুইয়ং বেঙ্গল” গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত হন। তাঁরা সবাই ইংরেজিতে কাব্য চর্চা করেছেন অনেকটা সেদিনের প্রচলিত বৌদ্ধিক প্রবণতার প্রভাবে। এঁদের মধ্যে কৃষ্ণ মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, লাল বিহারী দে ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত ধর্মান্তরিত হন বাকিরা স্বধর্মে স্থিত ছিলেন। মধুসূদন ও বঙ্কিম পরবর্তী জীবনে বাংলা ভাষায় কাব্য চর্চা করলেও বাকিরা আমৃত্যু ইংরেজিতেই সাহিত্য চর্চা করে গেছেন। এঁদের কারো কারো ইংরেজি কাব্য চর্চা ছিল খুবই মানসম্পন্ন। এঁদের মধ্যে তরু দত্ত, লাল বিহারী দে, মধূসূদনের ইংরেজি সাহিত্য চর্চা আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করে। তরু দত্তের “Ancient Ballads and Legends of Hindustan”, লাল বিহারীদের “Folk tales of Bengal” মধূসূদনের “Visions of the past” এবং “Captive Lady” ইঙ্গ বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত শুধু উনবিংশ শতাব্দীর ইঙ্গ বাংলা সাহিত্যের প্রভাবশালী কবি, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক নন বরং আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ও আলোচিত একজন কবি নিঃসন্দেহে। আধুনিকতার অর্থ যদি হয় জীবন ও জগতকে কোন পূর্ব নির্ধারিত বিশ্বাস ব্যতিরেকে যুক্তিবাদী ও মুক্তদৃষ্টিতে বিচার করা, মানুষকেই বিশ্বজগতের সীমার মধ্যে নান্দনিক বোধের অনিঃশেষ প্রেরণার উৎস হিসাবে বিবেচনা করা তাহলে মধুসূদন দত্ত উনবিংশ শতাব্দীর শুধু নয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি। ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সংস্কারমুক্ত ভাবাদর্শের মানবিক মেজাজে প্রাণিত মধূসূদন সমসাময়িক তরুণ তুর্কিদের মতো ইংরেজিতেই কাব্য চর্চা শুরু করেন ডিরোজিও’র জীবন ও কর্মের অনুপ্রেরণায়। উনবিংশ শতাব্দীর পুরো ’৪০ এর দশক থেকে ’৫০ এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি ইংরেজিতেই শুধু লিখেছেন। কাব্যে– কবিতায়, প্রবন্ধে–নিবন্ধে, ব্যক্তিগত পত্রালাপ মিলিয়ে– ইংরেজি সাহিত্য চর্চা, তাঁর ইংরেজি লেখার রূপদক্ষতা, অনায়াসলব্ধ ভাষা শৈলী, কাব্য প্রকরণ শুধু আলাদাভাবে বিচার্য বিষয় নয় বস্তুত এই ইংরেজি সাহিত্য চর্চা তাঁর বঙ্গভাষার ভান্ডারের বিবিধ রতন খোঁজ করতে এবং পরবর্তীতে বাংলায় কাব্য ও সনেট রচনার সাফল্যের মূলে কাজ করেছে। কিন্তু মধূসুদনের কাব্য প্রতিভা আলোচনা করতে গিয়ে, তাঁর সমুজ্জ্বল জীবন ও কর্মের নানামুখী আলোচনায় তাঁর ত্রিশ বছরের সাহিত্য জীবনের মধ্যে প্রথম যৌবনের আবেগে– আন্তরিকতায় প্রথম পনের বছরেরও বেশি সময় শুধু ইংরেজিতে সৃষ্ট অনুপেক্ষণীয়, অনিন্দ্যসুন্দর কাব্য প্রবাহের, নিবন্ধ, চিঠিপত্র ও অন্যান্য লেখার আলোচনা খুব কমই করা হয়ে থাকে যা মধূসূদনের প্রতিভা ও সাহিত্য আলোচনার খণ্ডিত বিচার হিসাবে বিবেচিত করা যায়। এতে কিন্তু মধূসূদন চর্চা অসম্পূর্ণ থেকে যায় বললে বাহুল্য হয় না।
এ ধারণা থেকেই মধূসূদনের ইংরেজি সাহিত্য চর্চা নিয়ে এ অপারঙ্গম আলোচনার দুঃসাহসিক প্রয়াস। তিনি ইংরেজি সাহিত্য চর্চায় সরাসরি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তাঁর শিক্ষক তৎকালীন হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ ডি.এল রিচার্ডসনের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে। রিচার্ডসনেরই সম্পাদিত “Calcutta literary Gleaner” পত্রিকায় ১৮৪১ সালে “My Fond Sweet Blue Eyed Maid” নামক কোন এক নীল নয়নাকে উদ্দেশ্য করে ইংরেজিতে লেখা প্রথম প্রেমের কবিতা প্রকাশিত হয়। মধুসূদনের ইংরেজি কাব্য চর্চার ইতিহাসকে মোটামুটি চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথমত হিন্দু কলেজের ছাত্রাবস্থা থেকে ধর্মান্তরিত হবার কারণে বহিষ্কৃত হয়ে বিশপস কলেজে অধ্যায়নকালীন ১৮৩৭–১৮৪৪ পর্যন্ত, দ্বিতীয়ত মাদ্রাজ প্রবাসকাল ১৮৪৮–৫৫ সাল, তৃতীয়ত কলকাতা ফেরার পরবর্তী পর্ব ১৮৫৬–৫৮ পর্যন্ত এবং চতুর্থ পর্যায় ১৮৫৯ সাল থেকে ১৮৭৩ সালে মৃত্যুর অব্যবহতি পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত বিক্ষিপ্ত কিছু প্রবন্ধ ও বিপুল পত্র সাহিত্য। এই চার বিচ্ছিন্ন পর্বের যোগসূত্র হিসাবে রয়েছে তাঁর চিঠিপত্র যেগুলোর সাহিত্য মূল্য তাঁর মৌলিক ইংরেজি রচনার চাইতে কোন অংশে কম নয় বরং বেশি। উপরোল্লিখিত চার পর্যায়ের ইংরেজি লেখার মধ্যে প্রথম দুপর্ব বিশেষত হিন্দু কলেজের ছাত্রাবস্থার পূর্বাপর সময়ে ১৮৪০ থেকে প্রায় ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত সাহিত্য জীবনের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি সময় জুড়ে তিনি মূলত ইংরেজিতেই লিখেছেন। ১৮৫০ এর শেষ দিক থেকে বিশেষ করে ১৮৫৯ সালে ুশর্মিষ্ঠাচ নাটক রচনার পর থেকে ১৮৬০ এর দশকের পুরো সময় তিনি প্রধানত বাংলা ভাষায় লিখেছেন, আর মূলত তাঁর ও অন্যদের কিছু সাহিত্য বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। কিন্তু সেদিন ইঙ্গ–বাংলা সাহিত্য দুকূল প্লাবী সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ভেসে গিয়েছিল তাঁদের দ্রোহী, মানবিক, মুক্ত ভাবনার বন্যায়। মধুসূদনের ইংরেজি সাহিত্য ভাবনা শুধু বিদেশী ভাষা সংস্কৃতির প্রতিই অনুরক্ত ছিল না– “Upsori”, “Visions of Past”, “Capitive lady”, “King Porous” এর মতো কাব্য ও কবিতায় পুরান মনস্কতার সাথে আধুনিক জীবন বোধকে একসূত্রে গ্রথিত করে দেখান যে তাঁর পায়ের নীচে বাংলার কাদামাটির বাস্তবতা বিরাজমান। প্রথম জীবনের Extemporary songs বলে পরিচিত কিছু কবিতায় হয়তো “I sigh for albion’s distant shore” এর মত দীর্ঘশ্বাস বিড়ম্বিত উচ্চারণ দেখতে পাই এমনকি অচেনা, অজানা সেই বিদেশে for glory or a nameless grave পর্যন্ত তাঁর কাম্য ছিল। এগুলোর পাশাপাশি “Epistle” লিখেছেন অনেক, ode লিখেছেন, ইতিহাস নির্ভর ballad, লিখেছেন প্রচলিত নিয়মকে উপেক্ষা করে বেশ কিছু sonnet লিখেছেন Blank verse এ। Blank verse এ প্রথম রচিত সনেট ‘Evening in saturn” নামক প্রথম সনেট লিখে তিনি তার একথা প্রমাণ করলেন ‘‘I am an enemy to what men call custom” King Porousএর মত প্রায় কাছাকাছি সময়ে রচিত “Uposori” ও একটি আখ্যান কাব্য। দুটোই ভারতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সমাপতনে ঋদ্ধ। এ পর্যায়ে তাঁর একটি গদ্যগ্রন্থ উল্লেখ করার মত। গ্রন্থটি হল “The Anglo Saxon and the Hindu”, lecture one” নামে মূলত একটি সেমিনারে প্রদত্ত বক্তৃতা। যা লেখা হয়েছিল Who is the stranger that has come amongst us? শিরোনামে। যাই হোক বইটি মধূসূদনের ইতিহাস চেতনা ও বিভিন্ন ধর্মতত্ত্বের নির্যাস নিয়ে প্রগাঢ় বৈদগ্ধ্যের প্রতিচ্ছবি। সেরিমারিস থেকে সাইপ্রেস, আলেকজান্ডার থেকে সিজার, নেপোলিয়ান প্রমুখ ইতিহাসের নায়কদের সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেও বলছেন “They were great, they were mighty but there is one greater and mightier still…. সেই one greater ও mightier হল তাঁর মতে জাতিগতভাবে ইংরেজ। মাদ্রাজে থাকার সময়েই প্রকাশিত হয় তাঁর সাত দৃশ্যে বিভক্ত একমাত্র ঐতিহাসিক ইংরেজি নাটক Rizia: the Empress of the Ind যা মাদ্রাজের ইউরেশিয়ান পত্রিকায় ১৮৪৯–৫০ সালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। মধ্যযুগের মুসলিম শাসন ও নানাবিধ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বর্ণনা তথা মুসলিম পটভূমি নিয়ে লেখা এই নাটক তখন হিন্দু প্রভাবিত ইতিহাস চেতনার প্রাবল্যে একটি ব্যতিক্রম। মুসলিম পটভূমি নিয়ে লেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে বন্ধু গৌরদাসকে লিখছেন “we ought to take up Indo Mussalman subjects. The Mohammedans are fiercer than ourselves and would afford splendid opportunities for the display of passion. মধুসূদনের এই উদার ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী সত্যিই প্রশংসনীয়। ুবুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোচ তে দেখি নিপীড়িতদের দ্রোহী নায়ক হলেন হানিফ গাজী। এই প্রবন্ধটি তাঁর ইংরেজি সাহিত্যের উপর বিস্তৃত আমার একটি আলোচনা নিবন্ধের অতি সংক্ষিপ্ত অংশ বিশেষ ।
তিনি সমসাময়িক সামাজিক সমস্যা, শিক্ষা, বাকস্বাধীনতা, নারীর অধিকার সহ আরো কিছু বিষয়ে ইংরেজিতে প্রচুর প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখেছেন নিজের সমাজ সচেতন সামাজিক বীক্ষার মননশীল ভাবনা থেকে। এ দিক থেকে তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্য বিচিত্র ভাবনায় ঋদ্ধ। তাঁর ইংরেজি চিঠিপত্রের সংখ্যা বিশাল। তাঁর বাংলায় কোন চিঠি আমার চোখে পড়ে নি। প্রধানত তাঁর কয়েকজন বন্ধুর কাছে সাহিত্য, সমাজ, ধর্মীয় কুসংস্কার ও সংস্কৃতি, এবং সামাজিক নিপীড়ন ও বৈষম্য নিয়ে এসব চিঠি রবীন্দ্রনাথের পত্র গুচ্ছের মত আলাদা আলোচনার দাবী রাখে। এই প্রবন্ধটি তাঁর ইংরেজি সাহিত্যের উপর বিস্তৃত আমার একটি আলোচনা নিবন্ধের অতি সংক্ষিপ্ত অংশ বিশেষ। ১৮৫৯ সালে শর্মিষ্টা নাটক লেখার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য চর্চা শুরু করলেও আমৃত্যু তিনি ইংরেজিতেই অনবরত চিঠিপত্র লিখেছেন। সেদিক থেকে তাঁর ইংরেজি সাহিত্য চর্চা ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত। শুধু বাংলার সাহিত্য সম্রাট নয়, প্রথম জীবনে ইঙ্গ–বাংলা সাহিত্যের অন্যতম লেখক বঙ্কিমের চোখে সেকালে মধুসূদন ছিলেন পরাধীন দেশ ও জাতি একজন দ্রোহী মহানায়ক। তাঁর মৃত্যুতে বঙ্কিমের সেই বহুল উদ্ধৃত ও গর্বিত উচ্চারণ মনে পড়ে সর্বাগ্রে “কাল প্রসন্ন, ইউরোপ সহায়–সুপবন বহিতেছে দেখিয়া জাতীয় পতাকা উডাইয়া দাও তাহাতে নাম লেখ “শ্রী মধুসুদন”।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ।