পৃথিবীতে যত স্থান আছে তন্মধ্যে সবচেয়ে উত্তম স্থান হলো মক্কা–মদিনা। মক্কা শহরে অবস্থিত পবিত্র মসজিদে হারাম। মদিনা হলো নবীজির (সা.) শহর, শান্তির নগর। রাসুলে করিম (সা.) বলেন যে আমার রওজা জিয়ারত করল তার জন্য আমার সাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেল। তিনি আরও বলেন যে হজ করল কিন্তু আমার রওজা জিয়ারত করল না সে আমার প্রতি জুলুম করল। নবী করিম (সা.) বলেন যে ব্যক্তি আমার মসজিদে (মসজিদে নববীতে) ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছে এবং কোনো নামাজ কাজা করেনি সে নিফাক (মুনাফিকি) আর দোজখের আজাব থেকে মুক্ত। মসজিদে নববীতে এক রাকাত নামাজের সওয়াব ৫০ হাজার রাকাত নামাজের সমান। মসজিদে নববীর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থান নবীজি (সা.) এর রওজা মোবারক। পবিত্র মক্কা–মদিনার বিভিন্ন জায়গায় দোয়া কবুল হয়ে থাকে। সে সব স্থানে আল্লাহতায়ালার ওপর পরিপূর্ণ আস্থা রেখে–মনোযোগসহ বিনম্রচিত্তে, অশ্রুসজল নয়নে দোয়া করা দরকার। দোয়া করলে সে দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। দোয়া কবুলের প্রসিদ্ধ কিছু–স্থান উল্লেখ করা হলো :
বায়তুল্লাহ শরিফ দৃষ্টিগোচর হলে : আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ দেখে দোয়া করা। বায়তুল্লাহ শরিফ দেখামাত্র দোয়া করা। বর্ণিত আছে বায়তুল্লাহ শরিফ প্রথম নজরে আসার পরে যে দোয়া করা হবে তা কবুল হবে।
হারাম শরিফ : হারাম শরিফের সীমানা বায়তুল্লাহর পশ্চিমে জেদ্দার পথে শুআইদিয়া পর্যন্ত ১০ মাইল, পূর্বে জেরুজালেমের পথে ৯ মাইল দক্ষিণে তায়েফের পথে ৭ মাইল এবং উত্তরে মদিনা শরিফের পথে ৫ মাইল।
মাসজিদুল হারাম মক্কায় দোয়া কবুলের স্থান মুলতাজেম : মুলতাজেম কাবা শরিফের দেয়ালের ছোট্ট একটি অংশের নাম। যা হাজরে আসওয়াাদ ও কাবার দরজার মাঝখানে অবস্থিত। এটি দোয়া কবুলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মসজিদুল হারাম হলো কাবা শরিফের চারদিকের বৃত্তাকার মসজিদ।
হাতিম : কাবা ঘরসংলগ্ন উত্তর দিকে অর্ধবৃত্তাকার দেয়ালঘেরা স্থান ‘হাতিম’ ও ‘হুজ্জাতু ইসমাইল’। এই স্থানটুকু আগে কাবাঘরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। নবী করিম (সা.) এর নবুয়তপ্রাপ্তির কিছুদিন আগে কাবাঘরের সংস্কার করা হয়। এ সময় হালাল অর্থের অভাবে পূর্ণ কাবা নির্মাণ সম্ভব হয়নি বিধায় হাতিম অংশ বাদ রেখে নির্মাণ করা হয়েছে।
মিজাবে রহমত : কাবাঘরের ছাদের পানি পড়ার জন্য উত্তর পাশে হাতিমের ভেতরে মাঝখান বরাবর সোনার পরনালা হচ্ছে মিজাবে রহমত।
কাবা শরিফের রোকনসমূহ : কাবাঘরের প্রত্যেক কোণকে রোকন বলা হয়। কাবাঘরের উত্তর–পূর্ব কোণকে বলা হয় রোকনে ইরাকি, উত্তর–পশ্চিম কোণকে বলা হয় রোকনে শামি এবং দক্ষিণ–পশ্চিম কোণকে বলা হয় রোকনে ইয়ামানি।
হাজরে আসওয়াদ : কাবাঘরের দক্ষিণ–পূর্ব কোণে দেয়ালে লাগানো জান্নাতি পাথর।
রোকনে ইয়ামানি ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যস্থল : তাওয়াফের প্রতি চক্করে এই স্থানে পড়তে হয় রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাছানা ওয়া ফিল আখিরাতি হাছানা ওয়া কি না আজাবান নার। (সুরা–২ বাকারা : আয়াত : ২০১)।
মাকামে ইব্রাহিম : কাবা শরিফের পূর্ব দিকে মাতাফের মধ্যে যে পাথরখণ্ড সংরক্ষিত আছে যার ওপর দাঁড়িয়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.) কাবাঘরের প্রাচীর গাঁথতেন।
সাফা : কাবা শরিফের পূর্ব পাশের নিকটতম পাহাড় যেখান থেকে সাঈ শুরু করতে হয়।
মারওয়া : সাফা থেকে থেকে ৪৫০ মিটার দূরত্বে মারওয়া পাহাড় অবস্থিত। এখানে সাঈ শেষ হয়।
আরাফাত : আরাফাত ময়দানে হজরত আদম (আ.) এর সঙ্গে হজরত হাওয়া (আ.) এর পুনর্মিলন হয় এবং এখানেই তাঁদের তওবা কবুল হয়। তাঁরা এই দোয়াটি পড়েছিলেন রাব্বানা জালামনা আনফুছানা ওয়া ইন লাম তাগফির লানা ওয়া তারহামনা লানাকুনান্না মিনাল খছিরিন। (সুরা–৭ আরাফ : আয়াত : ২৩)। হাদিসে এসেছে উত্তম দোয়া আরাফার দিবসের দোয়া এবং উত্তম কথা যা আমি এবং আমার আগের নবীরা বলেছেন। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই তিনি একক তার কোনো শরিক নেই রাজত্ব তারই প্রশংসাও তার তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান।
জাবালে রহমত : দয়ার পাহাড় এই পাহাড় আরাফাত ময়দানে অবস্থিত। আল্লাহর কাছে যা খুশি আপনি চাইতে পারেন।
মসজিদে নামিরা : আরাফাতের দিন এখান থেকে হজের ভাষণ দেওয়া হয়।
মুজদালিফা : এখানে বাবা আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.) প্রথম একত্রে রাত যাপন করেন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায়ের পর ‘কুজা’ পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে উপস্থিত হতেন এবং সেখানে তিনি অবস্থান করতেন। স্থানটি বর্তমানে মাশআরুল হারাম মসজিদের সম্মুখভাগে অবস্থিত। একেবারে আকাশ পরিষ্কার হওয়া পর্যন্ত দোয়া ও মোনাজাতে মশগুল থাকতে হয়। মূলত এটিই হলো মুজদালিফার মৌলিক আমল।
মিনা : শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের স্থান মিনা। আল্লাহতাআলার আদেশে হজরত ইব্রাহিম (আ.) স্বীয় তরুণ পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) কে যে স্থানে কোরবানির জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন সেই স্থানের নাম মিনা।
কঙ্কর নিক্ষেপের পর দোয়া করা : দোয়া কবুলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও সময় হচ্ছে জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ করে দোয়া করা। কঙ্কর নিক্ষেপের পর জামারার স্থান থেকে সামান্য সরে গিয়ে প্রাণ খুলে দোয়া করা।
মসজিদে খায়েফ : এটি মিনা প্রান্তরে অবস্থিত। এখানে আদিকাল থেকে আখেরি নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত ৭০ জন পয়গম্বর (আ.) আল্লাহর ইবাদত–বন্দেগি করেছেন।
জামারাত : মিনাতেই তিনটি জোমরা (স্তম্ভ) অবস্থিত, এগুলোকে একত্রে ‘জামারাত’ বলে। এগুলো ছোট শয়তান (জোমরায়ে উলা), মেজ শয়তান (জোমরায়ে উস্তা), বড় শয়তান (জোমরায়ে আকাবা) নামে পরিচিত। হজরত ইসমাইল (আ.) কে কোরবানির পথে এই স্থানে শয়তান বাধা সৃষ্টি করলে তিনি পাথর ছুড়ে তাকে বিতাড়িত করেন।
জমজমের পানি পান করার সময় : জমজমের পানি পান করার সময় দোয়া করা। জমজমের পানি পান করার সময় আপনার যা খুশি আল্লাহর কাছে চাইবেন। এখানে আপনি যা দোয়া করবেন আল্লাহতায়ালা তাই কবুল করবেন।
বিদায়ী তাওয়াফ শেষে : হজের সব কর্ম পালন শেষ করে দেশে ফেরার আগে বিদায়ী তাওয়াফ করতে হবে। তাওয়াফ শেষে আপনি মুলতাজামের কাছে চলে যাবেন। মুলতাজামে চেহারা, বুক, দুই বাহু ও দুই হাত রেখে দোয়া করবেন। এটিই আপনার শেষ সুযোগ। একে কাজে লাগান। আল্লাহর কাছে যা খুশি আপনি চাইতে পারেন।
রিয়াজুল জান্নাত অর্থ বেহেস্তের টুকরাতে দোয়া করা : মা আয়েশার ঘর থেকে মসজিদে নববীর মিম্বর এর মধ্যস্থিত স্থান। মসজিদে নববীর যে অংশ টুকুতে সবুজ রং এর কার্পেট বিছানো আছে। রসূল (সা.) এর রওজা ও মিম্বর এর মাঝে একটি জায়গা রয়েছে। যার নাম রিয়াজুল জান্নাহ বেহেশতের টুকরা। সেখানে নামাজ পড়া অনেক সৌভাগ্যের বিষয়। মক্কা শরিফে অবস্থানকালে নির্ধারিত ইবাদত ছাড়া সবচেয়ে বেশি পুণ্যময় ইবাদত হলো বাইতুল্লাহ শরিফ তথা খানায়ে কাবা তাওয়াফ করা। কাবাঘর সাতবার প্রদক্ষিণ করলে এক তাওয়াফ হয়। তাওয়াফ ডান দিক থেকে বাঁ দিকে করতে হয়। ফরজ ও ওয়াজিব তাওয়াফ ছাড়াও নফল তাওয়াফ অত্যন্ত ফজিলতের আমল। নামাজের সময় ছাড়া সব সময় তাওয়াফ করা যায়। উপরোল্লিখিত স্থানসমূহ ব্যতীত পুরো হারাম শরিফেও দোয়া কবুল হওয়ার কথা বর্ণিত আছে। দোয়া আরবিতেই করতে হবে এটা জরুরি নয়। হজ ও ওমরাহ সম্পন্ন করে বাড়িতে ফিরে আসার পরও ৪০ দিন পর্যন্ত হাজিদের দোয়া কবুল হতে থাকে এবং হাজি যত দিন পর্যন্ত ইচ্ছাকৃত কোনো কবিরা গুনাহে লিপ্ত না হবেন তত দিন পর্যন্ত তাঁর দোয়া কবুল হতে থাকবে। প্রত্যেক মুমিনকে আল্লাহতায়ালা মসজিদে নববীতে নবীজির রওজা জিয়ারতের তাওফিক দান করুন। হে আল্লাহ আমাদের সকলকে আপনার মকবুল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট