২৯শে এপ্রিল ১৯৯১ সাল। আজ থেকে তিন দশক আগে এ দিনটি ছিল প্রকৃতির নিষ্ঠুর আঘাতের ভয়ংকর একটি দিন। এ দিনের কালরাত্রিতে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও উদ্যত জলোচ্ছ্বাসে, চট্টগ্রাম মহানগরীর সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল পতেঙ্গা, হালিশহর, বন্দর, ইপিজেড, ডবলমুরিং ও কোতোয়ালীসহ বিস্তীর্ণ জনপদ লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে। সেই কালরাত্রির ধ্বংসযজ্ঞের বিভীষিকাময় এত বেশি ক্ষয়-ক্ষতি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে এত লাশের মিছিল চট্টগ্রামে আর কেউ কখনও দেখেছেন কিনা জানি না। ১৯৯১ এর ২৯শে এপ্রিল ভয়াল প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে বিদ্যুৎবিহীন, পানিবিহীন, যোগাযোগবিহীন, ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, হাড়ভাঙ্গা আক্রান্ত মানুষের করুণ আর্তনাদ ও বেঁচে থাকার আকুতিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। চট্টগ্রাম প্রায় একপক্ষ কালেরও বেশি বিদ্যুৎবিহীন ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছিল।
চট্টগ্রামের সিংহ পুরুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের তিন তিনবারের নির্বাচিত সাবেক মেয়র এ.বি.এম মহিউদ্দীন চৌধুরী ঐ সময়ে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোতোয়ালী আসন থেকে খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজয় তার মনে কোন বিরূপ রেখাপাত না রেখে নব উদ্যমে মানব প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে আরও সুদৃঢ়ভাবে ৯১এর ২৯শে এপ্রিল ভয়াল প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে বিপন্ন জনপদে ঝড়ের মত ছুটে গিয়ে নিজের হাতে অসংখ্য আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা, অসংখ্য লাশ দাফন-কাফন ও সৎকার করতে দেখে আমি শুধু বিস্মিতই হইনি- আমার পেশাগত জীবনে আমি মানবপ্রেম ও সেবায় আরও বেশি দীক্ষিত হই ।
পতেঙ্গা, বন্দর, হালিশহরে গিয়ে মহিউদ্দীন চৌধুরী প্রত্যক্ষ করেন আর্ত মানুষের করুণ আর্তনাদ ও বেঁচে থাকার আকুতি। দুর্গত এলাকায় ডায়রিয়া ও অন্যান্য মরণব্যাধি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এই দুর্গত এলাকায় অসহায় মানুষের চিকিৎসাসেবা প্রদান করার জন্যে ইপিজেড মোড়স্থ শ্রমিক লীগের দোতলা অফিসে একটি অস্থায়ী চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করেন। “ডায়রিয়া চিকিৎসা কেন্দ্র” নামে ঐ অস্থায়ী কেন্দ্রের এই মহান দায়িত্ব অর্পিত হলো আমার উপর। আমি, সৈয়দ মাহমুদুল হক ভাই, আব্দুর রহিম, প্রয়াত নোটনদা সহ আরও অনেকে ডেকোরেশন থেকে কয়েকটা টেবিল, চেয়ার ভাড়া করে ৫ বেডের অস্থায়ী চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করি। রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায়, জায়গার সংকুলান না হওয়ায় পরবর্তীতে ৪০নং ওয়ার্ডের হাজী মকবুল আহমেদ কন্ট্রাক্টরের বাড়িতে অস্থায়ী হাসপাতালটি স্থানান্তর করে অনেকদিন ডায়রিয়া, আমাশয়, কলেরা এবং অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছিল। প্রতিদিন মহিউদ্দীন চৌধুরী একবার করে সে হাসপাতালে স্যালাইন, ঔষধ ও খাবার নিয়ে যেতেন এবং রোগী ও আমরা যারা চিকিৎসা সেবায় জড়িত ছিলাম তাদের মনোবল শক্ত রাখার জন্যে নানারকম উপদেশ ও পরামর্শ দিতেন। দিন যতই যাচ্ছিল আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলছিল- চট্টগ্রাম নগরীতে তখন ডায়রিয়া মহামারী আকার ধারণ করেছিল। আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মহিউদ্দীন চৌধুরীর দ্রুত সিদ্ধান্তে মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে “অস্থায়ী ডায়রিয়া হাসপাতাল” চালু করা হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা আমার মেঝ মামা ডাঃ নুরুল আমিন চৌধুরীর (বর্তমানে প্রয়াত) নেতৃত্বে আমরা কিছু সংখ্যক নবীন চিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবক, মহানগর আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় রাতারাতি ডেকোরেশন হতে টেবিল, চেয়ার এনে রোগীর বেড বানিয়ে প্রায় ১৫০ বেডের অস্থায়ী হাসপাতাল প্রস্তুত করে সার্বক্ষণিকভাবে ডায়রিয়া ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছি।
চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে স্থাপিত অস্থায়ী ডায়রিয়া হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন সে সময়ের নবীন চিকিৎসক ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী। পাশে দণ্ডায়মান বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নন্দিত জননেতা এ.বি.এম. মহিউদ্দীন চৌধুরী। এখানেও ডাক্তার বলতে আমরা ক’জন নবীনরাই ছিলাম। রোগীদের ভিড়ে আমাদের গলদঘর্ম হলেও আমরা কখনও ক্লান্তবোধ করিনি। মহিউদ্দিন চৌধুরী’র ডাকে অগণিত ছাত্র, যুবক রাত-দিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে হাতে তৈরী হাজার হাজার স্যালাইন প্রস্তুত করেছেন, এমনকি মা-বোনেরাও স্যালাইন তৈরী ও রুটি বানাতে সাহায্য করেন। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে কোন দুর্যোগকালে শুধু চট্টগ্রাম কেন দেশের বাইরেও বেসরকারি উদ্যোগে এত বড় জরুরি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র তখন পর্যন্ত গড়ে উঠেনি। এ অস্থায়ী ক্যাম্পে জরুরি চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকলেও কখনো সেবা কাযক্রম থেমে যাওয়ার মত কোন ধরনের ঘাটতি ছিল না। এটা সত্য যে, উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা যদি মহৎ হয় মহান সৃষ্টিকর্তা তা কখনো ব্যর্থ হতে দেন না। আমি প্রত্যক্ষ করেছি যখন যা কিছু প্রয়োজন হচ্ছে মহিউদ্দিন চৌধুরী’র নির্দেশনায় সেগুলোর ঠিকমত যোগান অব্যাহত ছিল। ঐ সময় চট্টগ্রাম নগরীতে অনেক বিত্তবান, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ধনকুবের ছিলেন। তাঁদের প্রাচুর্য ও সক্ষমতার তুলনায় মহিউদ্দিন চৌধুরী’র সামর্থ্য তুচ্ছ মাত্র। তবে তাঁর মনোবল ও মানবপ্রেম, আর্ত মানবতার সেবাব্রত মানসিকতা সমুদ্রসম। এ মানবিক মানসিকতাবোধে মহিউদ্দিন চৌধুরী একজন সফল রাজনীতিকের চেয়েও অনেক বেশি বেশি মানবিক মহিউদ্দিন চৌধুরী। এ জন্যই তিনি একজন তৃণমূল কর্মী থেকে মাটি ও মানুষের নেতা হিসেবে আকাশ ছোঁয়া উচ্চতায় পৌঁছে গিয়ে জীবদ্দশায় কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।
মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা, মনে পড়ে মুসলিম হলের রোগীদের চিকিৎসা সেবার কথা ও ছোট ছোট আড্ডা। মনে পড়ে সেই চেনা মানুষগুলো প্রয়াত পুলিন দে, মরহুম এম.এ. মান্নান, মরহুম আতাউর রহমান খান কায়সার, মরহুম ডাঃ নুরুল আমীন চৌধুরী, মরহুম ডাঃ ছৈয়দুর রহমান চৌধুরী, মরহুম কাজী ইনামুল হক দানু, মরহুম ডাঃ আবু ইউসুফ আলম, মরহুম খালেকুজ্জামান, মরহুম লিয়াকত আলী, ইঞ্জিঃ মোশারফ হোসেন এম.পি., ডাঃ আফসারুল আমীন এম.পি., মোছলেম উদ্দিন আহমদ এম.পি., মিসেস হাসিনা মহিউদ্দীন, বদিউল আলম, মোহাম্মদ রেজাউল করিম চৌধুরী (মেয়র), আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু, এম.এ. সালাম, জহিরুল আলম দোভাষ, ডাঃ সরফরাজ খান চৌধুরী, ডাঃ শেখ শফিউল আজম, ডাঃ নাসিরুদ্দিন মাহমুদ, সৈয়দ মাহমুদুল হক, লিয়াকত আলী, এডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন বাবুল, এ.কে.এম. বেলায়েত হোসেন, চন্দন ধর, রঘুনাথ, জাহানারা বেগম, হাসান মাহমুদ শমসের, শাহীনুল ইসলাম, আশেক রসুল টিপু, ডাঃ মোহাম্মদ আলী, শফিকুল ইসলাম ফারুক, আব্দুর রহিম, আশীষ খাস্তগীরসহ অগণিত মুখ। সেই সুদূরের স্মৃতির পাতা থেকে হয়ত অনেকেরই নাম বাদ পড়েছে তাঁরা অবশ্যই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
লেখক : প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও প্রেসিডেন্ট, চিটাগং সিনিয়রস ক্লাব লিমিটেড।