শিশুরা সবসময়ই দুরন্ত হয়। অস্থিরতা, সবকিছু জানার আগ্রহ, কাজের ছলে অকাজ করা– এসব তাদের স্বভাবগত ধর্ম। কিন্তু আমরা, পরিবারের বড়রা শিশুদের এই দুরন্তপনা থামাতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের ভয় দেখাই। ভূতের ভয়, মারের ভয়, পুলিশের ভয়, ছেলেধরার ভয় ইত্যাদি বিভিন্নরকম ভয় দেখিয়ে তাদের বিভিন্নভাবে চাপে রাখার চেষ্টা করি। নিজের ইচ্ছেয় এক পা ফেলাতেও আমরা তাদেরকে যেভাবে ভয়ের সংকেত দিই তার প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী। শিশুমনে একটু একটু করে জমতে থাকা ভয় পরবর্তীতে স্বাভাবিকভাবে বড় হওয়া শিশুর ক্ষেত্রেও কোনো না কোনভাবেই তার মানসিক বৈকল্যের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাহ্যিকভাবে তা বোঝা না গেলেও মনের অভ্যন্তরীণ জমাটবদ্ধ অন্ধকার তার অজান্তেই একটু একটু করে তাকে গ্রাস করে।
অনেক পরিবারে শিশুরা তাদের বাবা–মাকে প্রচণ্ড ভয় পায়। সন্তানের চরিত্রগঠনে পরম বন্ধুর মত যাদের সবচেয়ে আগে পাশে দাঁড়ানোর কথা, তারাই যখন সন্তানের কাছে মূর্তিমান আতংকের প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠেন তখন সেই সন্তানের ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার হতেই বাধ্য! বাবা–মাকে এত ভয় পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে সে বলে, ‘বাবা খুব মারে‘। ‘মা খুব রাগী। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পড়া মুখস্থ বলতে গেলে বারবার শেখা পড়াও সব কেন জানি গুলিয়ে যায়! ‘
অনেক বাবা–মা মনে করেন, রক্তচক্ষু না দেখালে সন্তান কখনো মানুষ হবে না। পড়াশুনার ক্ষেত্রে এতটুকু ঢিলেমি দিলে সন্তান মাথায় চড়ে বসবে তখন! কিন্তু বুঝতে হবে,যে সন্তানটি পিতার লাঠিপেটা খেয়েছে, তার অনুভবে সেই লাঠির আঘাতটা এমনভাবে গেঁথে গেছে যে, মাটিতে পড়ে থাকা কোন লাঠি দেখলেও তার মনে ভয় হয়।
অনেকসময় বিদ্যালয়ে ছাত্র–ছাত্রীরা কিছুকিছু শিক্ষকের ক্লাস করতে ভয় পায়। পান থেকে চুন খসলেই সেই ভীতিকর শিক্ষকেরা ছাত্রদের অপমান,গালিগালাজ, এমনকি নৃশংসভাবে বেতের বাড়ি দিতেও দ্বিধা করেন না। তাই সেসব ভয় পাওয়া শিক্ষকদের ক্লাস করার সময় ছাত্ররা খুবই অস্বস্তিকর অবস্থায় থাকে বলে নিজেদের স্বাভাবিক অবস্থা ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধটাই তারা হারিয়ে ফেলে। ফলশ্রুতিতে আবারো ঐ নিরীহ ছাত্রের কপালে জোটে আরেকদফা তিরস্কার, অপমান আর মার।
এটা ঠিক যে, ছোটোদের ভবিষ্যতের সঠিক পথটিতে এগিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে আদর স্নেহের পাশাপাশি তাদের শাসনেরও প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেই শাসনের মাধ্যমটা যেন সঠিক হয় সেই ব্যাপারটিতে ভালোভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে অভিভাবকদেরকেই। আমরা যতই বারেবারে তাদের বলি না কেন, ‘অবাধ্য হবেনা‘, ‘বড়দের কথা শুনবে‘, ‘তোমাদের ভালোর জন্যই বড়রা তোমাদের শাসন করেন ‘ ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু ঠাণ্ডামাথায় আমাদের বড়দেরও তো একবার ভাবা দরকার যে, শিশু হলেও তারও একটা মন আছে, আর সেই মনে কিছু ইচ্ছে অনিচ্ছেও আছে। একটা শিশুকে শিক্ষা দেবার নামে, পড়াশুনার নামে, শাসনের নামে যদি একনাগাড়ে ভয় দেখানো হয়, পেটানো হয়, তাহলে তার মনের কোণে বিরাট এক ভয়ের গহ্বর তৈরী হবে, আর সেই গহ্বর থেকে জন্ম হতে পারে অপরাধপ্রবণতার। মস্তিষ্কের সাথে স্নায়ুর সঠিক সংযোগস্থাপনটা না হলে শিশুর সুস্থ মানসিক গঠনও বাধাপ্রাপ্ত হবে। দেশ ও জাতিগঠনে যার কুপ্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।
ভূত–প্রেত নিয়ে কুসংস্কার, যৌথপরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুকে পরিবারের কোনকোন সদস্যদের থেকে সাবধান থাকার কুশিক্ষা দেয়া, ইত্যাদি বিষয় থেকে শিশুকে দূরে রাখা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ, পিতামাতার দেয়া এসব অমূলক সাবধানবাণীগুলোকে সম্বল করে শিশুমন তার ভাবনায় নিজেনিজে এক কাল্পনিকজগত তৈরী করে, এবং পরবর্তীতে সে বিকারগ্রস্ত হয়েও পড়তে পারে। মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি অমূলক ভয় কিন্তু অনেক সময় আপনজনদের মধ্যেও দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়।
এবার আসি অপরাধপ্রবণতায়। এটা বিশ শতাংশই মাত্র জিনগত। বাকী আশি শতাংশই হচ্ছে পরিবেশগত। তবে বিষয়টা নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা–নিরীক্ষার ব্যাপার আছে বলে সেসব সারগর্ভ আলোচনায় আমি যাচ্ছি না। আমার বক্তব্য হলো, আমরা শিশুকে একটা ভয় আর শংকামুক্ত পরিবেশ উপহার দেবো, সেটা বাড়িতেই হোক বা বিদ্যালয়ে। প্রত্যেকটা শিশুর পছন্দ–অপছন্দকে আমলে নেয়ার শিক্ষা আমাদেরও গ্রহণ করতে হবে। শিশুর সাথে সকলের সম্পর্ক হতে হবে ভয়হীন আর নিশঙ্ক! মস্তিষ্কে ‘ভয়’ নামক জমাটবাঁধা অন্ধকার থাকলে সেখান থেকে আলো বেরোবে না। শিশুদের মন হয় কাঁচাসোনার মতো নরম। আর এটা বলাই বাহুল্য যে, নরম মনেই ভয়ের বাসা বেশী বাঁধে। তাই তাদেরকে শেখাতে হবে ভয়কে কিভাবে জয় করা যায়।
আর আমরা যারা শিশুদের পরিবার পরিজন আছি তাদের কথা আর কি বলবো? এই যান্ত্রিকযুগে আমরা সবাই যেন এক একটা যন্ত্রে রূপান্তরিত হয়ে চলেছি! নিজের অজান্তেই একটা বিরক্তি আর অবসন্নতা যেন ধীরেধীরে আমাদের মনটাকে পুরোপুরিভাবেই গ্রাস করে নিচ্ছে। নিজেদের অপ্রাপ্তির এই ক্ষোভ আর কোথাও প্রকাশ করতে না পেরে মাঝেমধ্যে নিজের অবোধ সন্তানটির উপরেই করে ফেলি। তার সামান্য একটা ভুলের জন্য তাকে রূঢ়ভাবে বকাঝকা করি। মারধরও করি। আবার পরক্ষণে অবশ্য নিজের ভুল বুঝে কষ্ট পেলেও সেই কষ্টের প্রতিকার আর হয় কোথায়? যে শিশুটি পেটানি খেলো তার মনের মধ্যে তো পিতা/মাতার এই নিষ্ঠুর আচরণটা যখনতখন অনুরণিত হবে, যা পরবর্তীতে তাদের শতআদর–ভালোবাসাতেও কিছুটা মাত্র ভোলানো যায়। পরিশেষে এটাই বলতে চাই, শিশুকে তার গঠনপর্যায়ে আদর ও ভালোবাসা দিন। রূঢ় না হয়ে ভালোবেসেও ভালোমন্দের ফারাক শেখানো যায়। এজন্য সুন্দর ও সুষ্ঠু একটা পারিবারিক পরিবেশ অত্যন্ত প্রয়োজন। আসুন, আর ভয় নয়, শিশুকে আমরা জয়ের পথ দেখাই।
লেখক : প্রাবন্ধিক