পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়! মহামারীর কালে বদ্ধ দরজার ওপাশেই, এই কড়া নাড়লো বলে! করোনা ভ্যাকসিন বা টিকার কথা বলছিলাম। করোনায় পরিবর্তিত জীবনযাত্রাকে আবার স্বাভাবিক করতে এর প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
বিগত শতাব্দীতে ব্যাকটেরিয়া,ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসা কৌশল। বিশ্বে গুটিবসন্ত নির্মূল, পোলিও প্রায় নির্মূলের পথে এসব কৃতিত্ব ভ্যাকসিনের ঝুলিতে। বিশ্বে প্রতিবছর দুই থেকে তিন মিলিয়ন প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হয় এই ভ্যাকসিন দ্বারা।
ভ্যাকসিন হচ্ছে জৈব রোগ প্রতিষেধক উপাদান যা শরীরে প্রয়োগ করলে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা (এন্টিবডি ইত্যাদি উৎপাদন এর মাধ্যমে) সুনির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সাধারণত সেই রোগের জীবাণু নিস্ক্রিয় করে,জীবাণুর বিষক্রিয়া নষ্ট করে ভ্যাকসিন তৈরী করা হয়, যেটা ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ প্রক্রিয়াকে আগন্তুক হিসেবে প্রদর্শনের মাধ্যমে এর সাথে যুদ্ধ করতে প্রশিক্ষিত করে তোলে। বর্তমানে জেনেটিক ও মোলিকিউলার বায়োলজির অগ্রগতির সাথে সাথে ভ্যাকসিন তৈরির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এখানেই ভ্যাকসিন তৈরির গল্প শেষ নয় এর সাথে প্রয়োজনমতএডজুভেন্ট, সংরক্ষণ উপাদানও যুক্ত করা হয়, এরপর তাকে চার ফেজের মানোত্তীর্ণ ধাপ পার হতে হয়, সব ধাপে সন্তোষজনক ফলাফল, তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে ভ্যাকসিন স্বীকৃতি পায়। প্রিক্লিনিক্যাল ট্রায়াল মানুষ ভিন্ন অন্য প্রাণী ( বানর, ইঁদুর, খরগোশ ইত্যাদি) তে প্রয়োগ করা হয়, ক্লিনিক্যাল থেকে মানুষের উপর পর্যায়ক্রমে ফেজ-১ নিরাপত্তা ট্রায়াল : অল্প কয়েকজনের উপর প্রয়োগ করে দেখা হয়, ফেজ -২ বর্ধিতট্রায়াল : ১০০ জনের উপর শ্রেণি ভিত্তিক (শিশু, বৃদ্ধ ইত্যাদি) ট্রায়াল, ফেজ -৩ সক্ষমতা ট্রায়াল : ১০০০ জনের উপর প্রয়োগ করে তুলনা করে দেখা হয় ভ্যাকসিন নেয়া ও ভ্যাকসিন ছাড়া প্লাসিবো নেয়া গ্রুপের মধ্যে কতভাগ প্রতিরোধে সক্ষম। ৫০% ভ্যাকসিন নেয়াদের প্রতিরোধ সক্ষম কিনা সেই তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে নিরাপদ হলে সে ভ্যাকসিন স্বীকৃত হয়। ফেজ ১ এবং ২ একই সাথে ট্রায়াল দিয়ে কম্বাইনড ফেজ পরীক্ষা অনেক সময় প্যানডেমিক কালে চালানো হয় সময় সাশ্রয়ী করতে। নিয়ম অনুযায়ী ভ্যাকসিন আসতে কয়েক বছর লেগে যায়। কিন্তু মহামারীকালে দ্রুত ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে চেষ্টা করা হয় যদিও তাতে ঝুঁকি একটু থেকেই যায়।
বিভিন্ন দেশের ১৯৮ টি করোনা ভ্যাকসিন এর উদ্ভাবন এর১৫৬ টি প্রিক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যায়ে আছে, ২১ টি ফেজ -১, ১২ টি ফেজ-২, ফেজ- ৩ ট্রায়ালে আছে ১১ টি ভ্যাকসিন, শেষ পর্যায়ের এ ১১টি স্বীকৃত হতে ন্যূনতম ১ সপ্তাহ থেকে ১ মাস লাগতে পারে।কিন্তু ব্যাপক সরবরাহের পর্যায়ে পৌঁছাতে ২০২১ এর মাঝামাঝি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ট্রায়াল বিবেচনায় দৌড়ে অঙফোর্ড এর আ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটিকে এখন পর্যন্ত এগিয়ে আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ফাইজারের ভ্যাকসিন সক্ষমতার বিচারে ৯০% এর বেশি সফল বলে জানা গেছে।
করোনা ভ্যাকসিন তৈরিতে ফাইজার, মডার্না ব্যবহার করেছে করোনা ভাইরাসের জেনেটিক কোড এটি শরীরে ঢুকানোর পর ভাইরাল প্রোটিন তৈরি করবে যার সাথে শরীরের ইমিউন সিস্টেম করোনা লড়াইয়ের কৌশলে প্রশিক্ষিত হবে।এটি সম্পূর্ণ নতুন একটি কৌশল।
অঙফোর্ড এবং রাশিয়া ব্যবহার করেছে জেনেটিক রূপান্তর করা নির্দোষ একটি ভাইরাস যেটা করোনার মতো আচরণ করে ইমিউন সিস্টেমকে লড়াই করতে শেখাবে।
চীনা দুটি ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে আসল করোনা ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে। বসে নেই আমাদের দেশও, ব্যানকোভিড নামে গ্লোববায়োটেক ডিএনএ প্লাজমিড নিয়ে ভ্যাকসিন তৈরি করে প্রিক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সাফল্য পেয়েছে এবং আই সি ডি আর বি এর হিউম্যান ( মানব) ট্রায়ালে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভ্যাকসিনটি তালিকাভুক্ত করেছে।
বিশ্বের প্রায় ৬০-৭০% লোকের জন্য ভ্যাকসিন তৈরি করতে হবে নয়তো করোনার বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন সম্ভব নয়। বয়স ৮০, স্বাস্থ্য সেবার সাথে সংশ্লিষ্টরা ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার পাবে। বাংলাদেশের বেঙ্মিকো ভারতে সিরাম এ প্রস্তুতকৃত বৃটিশ আ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন টির ৩০ মিলিয়ন ডোজ বাজারে ছাড়া মাত্রই আনবে বলে উচ্চপর্যায়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এতে করোনা মুক্ত করতে ২৮ দিনের ব্যবধানে দুই ডোজে ১৫ মিলিয়ন লোককে প্রয়োগ করা
সম্ভব হবে।
যদি সফল ভ্যাকসিন না আসে তাহলে কি হবে? নিরাশ হবার দরকার নেই, বিকল্প উপায় হচ্ছে ভালো চিকিৎসা। ভালো চিকিৎসা আবিষ্কৃত হলেও আমরা করোনা যুদ্ধ জয় করতে সক্ষম হব ইনশাআল্লাহ। এমন অনেক রোগ যেমন এইচআইভি’র কোন ভ্যাকসিন নেই, কিন্তু এর সৃষ্ট এইডস রোগের ভালো চিকিৎসা বর্তমানে আমাদের হাতে আছে বলে তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে।
সহজ কথা আশার আলো আছে আমাদের সামনে। শুধু কিছুটা পথ পেরুতে হবে আলো আনতে কিন্তু সে পর্যন্ত নিরাপদে থাকতে সাবান দিয়ে বারে বারে হাতধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহার – এ স্বাস্থ্য বিধিকেই সচেতনভাবে আত্মরক্ষার বর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
লেখক: চিকিৎসক; সিনিয়র মেডিকেল অফিসার, চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতাল