জাতীয় সংসদে নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন, দলের প্রাথমিক সদস্য পদে তিন বছরের কম হলে প্রার্থিতার সুযোগ না রাখাসসহ নির্বাচন বিষয়ক একগুচ্ছ সংস্কারের সুপারিশ করেছেন বিভিন্ন দলের নেতা ও সংশ্লিষ্টরা। গতকাল শনিবার রাজধানী সিরডাপ মিলনায়তনে রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আরএফইডি) আয়োজিত ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কেমন চাই’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব সুপারিশ করেন। এদিকে বক্তব্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্বাচন কমিশনের খবরদারির ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করেছেন বস্ত্র ও পাট এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। নির্বাচন কমিশনে নিয়োগে সরকারের যেন হস্তক্ষেপ না থাকে, সেটিও নিশ্চিত করতে বলেছেন তিনি।
তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় মন্ত্রণালয়গুলোর ওপর খবরদারির ক্ষমতা ইসিকে দিতে হবে। নির্বাচন কমিশন যাদেরকে নিয়োগ দেয়, তাদের ক্ষেত্রে ইসি যে রিপোর্ট দেয় সেটিই যেন চূড়ান্ত হয়। এটির জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার যেন হস্তক্ষেপ না করে। খবর বাংলানিউজ ও বিডিনিউজের।
নির্বাচন কমিশনার নিয়োগই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে তিনি বলেন, একটা প্রস্তাব রয়েছে… তিন ধাপে, প্রথম ধাপ প্রিলিমিনারি সিলেকশন, সেকেন্ড ধাপ সেকেন্ড সিলেকশন, থার্ড ধাপে পার্লামেন্টে যারা আছেন সরকারি দল এবং বেসরকারি দল। তাদের কমিটির মাধ্যমে ফাইনাল সিলেকশন হবে। দুইজনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে এবং সেখান থেকে একজন ফাইনাল সিলেকশন হবে। এখানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো হস্তক্ষেপ হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীও থাকছেন সেখানে, বিরোধী দলীয় নেতারাও থাকছেন। তাই এখানে সমান সমান অনুপাতে রিপ্রেজেন্টেশন হবে, সেখানে আলোচনা হবে। সেই আলোচনার মাধ্যমেই সিলেকশন হবে। প্রাথমিক আলোচনায় যে নামগুলো আসবে, সে নামগুলো সবাই জানতে পারবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আপনারাই আলোচনা করতে পারবেন যে, উনাকে দিয়ে হবে কি হবে না। এখন যেমন কারও নাম উঠলেই তার আদ্যোপান্ত খুঁজে বের করে, তো সেগুলো তখন পরিষ্কার হবে।
কমপক্ষে তিন বছর কোনো দলের সদস্য না থাকলে সেই দলের প্রার্থী হতে না পারার বিধান করার তাগিদও দেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা টাকা নিয়ে চলে আসে। যে ১০ কোটি টাকা দিয়ে নমিনেশন কিনল, সে আরও ২০ কোটি টাকা খরচ করবে যাতে ইলেকশনে উনি জিততে পারেন। পলিটিশিয়ানরা নির্বাচনের ধারে কাছে নেই, যারা বড় বড় বিজনেসম্যান তারা নমিনেশন কিনে চলে আসছে। যারা পলিটিঙ করে তাদের জন্য নমিনেশন হয় না। দলগুলোকে তৃণমূল থেকে প্রার্থী বাছাইয়ের পরামর্শও দেন সাখাওয়াত।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করেই সংস্কার কমিশন কাজ করবে। জনগণের সঙ্গে যতটুকু সম্ভব কথা বলা দরকার। সুষ্ঠু নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতার অভাব। তারা সুযোগ পেলে নিরঙ্কুশ জয় পেতে চায়। যদি দলগুলো চায় প্রশ্নহীন নির্বাচন হতে পারে। সংবিধানের কাঠামোই এমন করা হয়েছে যে স্বৈরাচারী; ওইখানে সরকার প্রধান জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার। অন্তত তিন থেকে পাঁচটি নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন হতে হবে। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের দাবি এসেছে। এক্ষেত্রে সংসদের উচ্চ কক্ষ থেকে সদস্যদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। এতে এক সময় হয়তো আমরা এমন জায়গায় পৌঁছাব যে, দলীয় সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োজন হবে না।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার ক্ষেত্রে যদি দেখি সেখাবে সচিব ও অতিরিক্তি সচিব সরকার থেকে হয়। এজন্য ইসি পুরো নিয়োগ স্বতন্ত্র হতে হবে। আমরা মনে করি নির্বাচনী ব্যয় একটা টাকার খেলা, পেশি শক্তি, বিদ্বেষ ছড়ানো যাবে না। মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ করতে দলের প্রাইমারি পর্যায়ে প্রার্থী বাছাই করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা, খেলোয়াড়, প্রার্থী হতে পারবে কিনা, দল পরিবর্তনের বিষয় আলোচনা করতে হবে। এছাড়া দল নিবন্ধনের শর্ত কঠিন। এতে সংকট সৃষ্টি হয়। এতে নতুন দল গঠনের ক্ষেত্রে উৎসাহের জন্য সহজ শর্ত করা দরকার।
শিবিরের সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. মু. শফিকুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনী সংস্কারে নয়টি পয়েন্ট সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে আমরা তুলে ধরেছি। সংসদে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন। এতে সকল মানুষের প্রতিনিধি সংসদে থাকবে। স্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রণয়ন করা। কেননা দেশে যত নির্বাচন হয়েছে, এগুলোর মধ্যে তত্ত্ববধায়ক সরকারের আমলের তিনটি নির্বাচন সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। ইভিএম বাতিল করতে হবে। সরকারি চাকরিজীবী চাকরি ছাড়ার তিন বছরের মধ্যে কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। স্থানীয় নির্বাচন নির্দলীয় করতে হবে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য নিবন্ধন প্রথা বাতিল করতে হবে। নির্বাচন একাধিক দিনে সম্পন্ন করতে হবে।
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, শুধু নির্বাচনের জন্য এত মানুষ প্রাণ দেয় নাই। প্রশাসনে বিএনপি–জামায়াতের আধিপত্য কায়েম করা চলবে না। আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। আমি মনে করি সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। স্থানীয় নির্বাচন নির্দলীয় করতে হবে। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা করতে হবে। দল নিবন্ধন প্রথা সঠিক। তবে গত সরকার এর অপব্যবহার করেছে। নিবন্ধিত দলগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে সরকারকে। রাষ্ট্রের যৌক্তিক সরকার চাই। এজন্য সকল দলে সহায়তা নিতে হবে।
আলোচনার পর নির্বাচন সংস্কার বিষয়ক কমিশনের প্রধান ও সুশাসনের জন্য নাগরিক–সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগের ক্ষমতা আমাদের নেই। এটা করবে অন্তর্বর্তী সরকার। আমাদের এখতিয়ার হলো কতগুলো সংস্কারের সুপারিশ করা। আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো এখতিয়ার নেই। একটা আলাপ– আলোচনা হতে পারে। আমাদের কতগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে হবে, ভোটার তালিকা করতে হবে। রাজনৈতিক দল সকলেই মতামত ব্যক্ত করুক। কিছু সংস্কারের জন্য সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা সংবিধান সংস্কার বিষয়ক কমিশন দেখবে। আমরাও দলগুলো কাছ থেকে প্রস্তাব নেব। সংখ্যানুপাতিক ভোটের জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশন সিদ্ধান্ত দিতে আমরা সেভাবে প্রস্তাব করব।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন একটা প্রক্রিয়া। ভোটার তালিকা থেকে শুরু হয়, এরপর মনোনয়ন বাছাই, প্রচার, ভোটগ্রহণ। এই প্রক্রিয়া নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এজন্য ইসিকে পর্যবেক্ষণ করতে হব। পুরো প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতীয়মান হতে হবে।
তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিকভাবে বাতিল করা হয়েছিল। এটা করা হয়েছিল ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য। এজন্য নির্বাচনকালীন একটা নিরপেক্ষ সরকার দরকার, সে যেভাবে হোক। সরকার মানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন নিরপেক্ষ আচরণ করে। এরপর হলো দল। দল যদি দায়িত্বশীল না হয়। তারা যদি ছলে বলে কৌশলে টাকার খেলা করে, পেশি শক্তির ব্যবহার করে, গণমাধ্যম যদি সঠিক খবর না দেয় তাহলে সঠিক নির্বাচন ব্যাহত হয়। এতে সুষ্ঠু নির্বাচন কল্পনাতেই থেকে যাবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক ঐক্যমত থাকতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে। টাকা দিয়ে, পেশি শক্তি দিয়ে যদি ভোটে জিততে চাই, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনই থাকবে। তাই যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা সততা, নিষ্ঠা, পেশাদারিত্বের সঙ্গে আমরা আমাদের প্রস্তাব উত্থাপন করব।
আরএফইডির সভাপতি আকরামুল হক সায়েমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘নির্বাচন ব্যবস্থা কেমন সংস্কার চাই’ শীর্ষক সেমিনারে আয়োজক সংগঠন নেতৃবৃন্দসহ অন্য দলগুলোর নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।