এক সপ্তাহের ব্যবধানে চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে ভোজ্য তেলের দাম। এক সপ্তাহ আগে যে তেল ১১০ টাকা লিটার বিক্রি হয়েছিল গতকাল তা বিক্রি হচ্ছিল ১২০ টাকা দরে। আবার পাঁচ লিটারের বোতল ৫৯০ টাকা থেকে বেড়ে গতকাল বিক্রি হচ্ছিল ৬২০ টাকা দরে। গত দুদিনে পামতেল এবং সয়াবিন তেলের দাম প্রতি মণে বেড়েছে আরো ২শ টাকা। পাইকারিতে তেলের দাম বাড়ায় খুচরা বাজারেও বেড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। পাইকারি বাজারে দাম বাড়ার জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন অনেকে। তবে দেশে ভোজ্য তেলের প্রচুর মজুদ থাকার কথা উল্লেখ করে পুরো ব্যাপারটির পেছনে বিশেষ একটি সিন্ডিকেটের কারসাজি রয়েছে বলে অভিযোগ করে সংশ্লিষ্ট বাজার বিশ্লেষকেরা বলছন, সরকারের বিশেষ নজরদারি ছাড়া ভোজ্য তেলের বাজার নিয়ে সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা ঠেকানো সম্ভব হবে না।
সূত্র জানায়, ভোজ্য তেলের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে গত বেশ কিছুদিন ধরে। তেলের দর উঠানামা করছে। তবে এক সপ্তাহের ব্যবধানে চট্টগ্রামের বাজারে তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বোতলজাত এবং খোলা উভয় ধরনের তেলের বাজার নিয়ে অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে। সয়াবিন এবং পাম অয়েল- উভয় ধরনের তেলের দর পাইকারি ও খুচরা বাজারে বাড়ানো হয়েছে।
রূপচান্দা ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল প্রতি লিটার বোতল গত সপ্তাহে বিক্রি করা হয়েছিল ১১৫ টাকা। গতকাল একই বোতল ১২৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। পলি প্যাক করা তেলের দামও একই হারে বেড়েছে।
গতকাল নগরীর মোমিন রোড এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী জানান, তারা বাড়তি দামে ভোজ্য তেল বিক্রি করছেন। পাইকারি বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় হওয়ায় দেশের বাজারেও ভোজ্য তেলের দাম বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের সরবরাহ কমে গেছে উল্লেখ করে তারা বলেন, করোনা মহামারি এবং চীনের বাড়তি তেল কেনার প্রভাব পড়েছে বিশ্ববাজারে। তবে ভোক্তারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা বাজারের চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে দাম বৃদ্ধি করেন। দেখা যায়, আমদানি মূল্যের সাথে বিক্রয় মূল্যের বিরাট ব্যবধান। এছাড়া যেসব তেল এখন মজুদ করা আছে, সেগুলো আমদানি হয়েছে আগে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বুকিং রেট বাড়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে দামও বাড়িয়ে দিয়েছেন যা অনুচিত। গতকাল খাতুনগঞ্জের বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সপ্তাহে প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) পাম তেল বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৩০০ টাকায়। দুদিনের ব্যবধানে মণপ্রতি ২০০ টাকা বেয়ে গিয়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। এছাড়া গত চারমাস আগে প্রতি মণ পাম তেল বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৬০০ টাকায়। অন্যদিকে বর্তমানে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ৪ হাজার ৫০০ টাকায়। গত সপ্তাহে এই তেল বিক্রি হয়েছে ৪হাজার ৩০০ টাকায়। এছাড়া গত চারমাস আগে বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৮০০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের কয়েকজন তেল ব্যবসায়ী জানান, খাতুনগঞ্জের বাজারে পণ্য বেচাকেনা ও লেনদেনে যুগ যুগ ধরে কিছু প্রথা চালু আছে। নিজেদের সুবিধার অনেক প্রথা আছে যেগুলো আবার আইনগতভাবেও স্বীকৃত নয়। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) স্লিপ। তেল কিংবা অন্য কোনো পণ্য কেনাবেচায় ডিও বেচাকেনার মাধ্যমে বিভিন্ন আগাম লেনদেন হচ্ছে। দেখা যায়, পণ্য হাতে না পেলেও ওই ওই স্লিপটিই বেচাকেনা হচ্ছে। কোনো কোম্পানি বাজার থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্যের ডিও কিনে নেয়। যে দরে ডিও কেনা হয় তার বাজার দর যদি বেড়ে যায়, তখন পণ্যটি ডেলিভারি দিতে তারা গড়িমসি করে। আবার দেখা যায়, কোম্পানির পণ্যই আসেনি কিন্তু ডিও কিনে রেখেছে অনেক বেশি। এর ফলেও কোম্পানি বাজারে পণ্য ডেলিভারি দিতে পারে না। ফলে এসব পণ্যের দামও নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এক্ষেত্রে তেল ও চিনির ডিও বেচাকেনা বেশি হয়। বলা যায় ডিও কারসাজির কারণে মাঝে মাঝে পণ্যের দাম আকাশচুম্বি হয়ে উঠে। এই সুযোগে কিছু মৌসুমী ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জের তেল ব্যবসায়ী মেসার্স দ্বীন সিন্ডিকেটের স্বত্বাধিকারী জামাল উদ্দিন আজাদীকে বলেন, তেলের বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার সুযোগ নেই। এখন মানুষ অনেক সচেতন। যে কেউ অনলাইনে আন্তর্জাতিক দর যাচাই করতে পারেন। বাজারে দাম বাড়লে সবাই বলতে থাকেন ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বৃদ্ধি করছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের চাহিদা বেড়ে গেছে। ব্রাজিল আর্জেন্টিনা সয়াবিনের বড় রপ্তানিকারক দেশ। চীন দেশ দুটি থেকে সয়াবিন কিনে মজুদ করে রাখছে। যার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম স্থিতিশীল থাকছে না। একই বিষয়টি পাম তেলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বুকিং রেট এখন আগের তুলনায় অস্বাভাবিক বেড়েছে।
ক্যাবের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে ভোজ্য তেলের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, সরকারি নজরদারি না বাড়লে সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা ঠেকানো যাবে না। তিনি কঠোরভাবে বাজার মনিটরিং এর আহ্বান জানিয়েছেন