ভোগ নয় ত্যাগেই আনন্দ : প্রসঙ্গ- কোরবানীর ঈদ

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ৩ জুন, ২০২৫ at ১০:৪৯ পূর্বাহ্ণ

কয়েকদিন পরে শুরু হতে যাচ্ছে কোরবানী ঈদ বা ঈদুল আযহা। এবার প্রথমবারের মতো দীর্ঘ ছুটির ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে দেশ। শিক্ষা সাংস্কৃতি ও ধর্মীয় মিলন বন্ধনের এক অপার সৌন্দর্যের মেলবন্ধনের এদেশ। আদিকাল হতে এদেশে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান বিভিন্ন ধর্মের গোত্রের মানুষের বসবাস। প্রত্যেকে তাঁদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে উৎসব পালন করে থাকে। এদেশেই সম্ভব সদন্তে উচ্চারণ ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’।

সময়ের ধারাবাহিকতায় আজ আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছে মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় উৎসব ‘ঈদুল আযহা’ যেটি কোরবানী ঈদ হিসেবে সমধিক পরিচিত।

ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে সমপ্রীতি, ঈদ মানে ভ্রাতৃত্বের অটুট বন্ধন। ঈদের আগমনে মুছে যাক সকল পাপ, পঙ্কিলতা কালিমা, নিভিয়ে দিক সকল প্রকার হিংসা, বিদ্বেষ, কাম, লোভ, লালসা আর ক্ষোভের আগুন। শান্তি, সমপ্রীতি ভ্রাতৃত্বের সাম্যের গান গেয়ে ঈদকে সামনে রেখে নিজেকে বিলিয়ে দেবার চেষ্টায় ঈদের আনন্দ।

আদিকাল হতে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় আমরা দেখেছি, কোরবানী ঈদের চাঁদ দেখার পর হতে শুরু হয় এর প্রস্তুতি। হলুদ, মরিচ, মসলা শুকিয়ে ভাঙ্গানোর ব্যবস্থা। চাউল শুকিয়ে ভাঙিয়ে গুড়ি করা এবং কোরবানীর জন্য গরু, ছাগল ক্রয়ে উৎসব উৎসব ভাব। বন্ধু বান্ধব নিয়ে বাবা চাচাদের সাথে মিলে বাজারে গিয়ে গরু কিনে তা দল বেঁধে বাড়িতে নিয়ে আসার যে আনন্দ তা আমাকে এখনো উদ্বেলিত করে।

ঈদের দিন সকালে নামাজ সেরে গরু ছাগল জবেহ করে পাড়ার সকলে মিলে তা কেটেকুটে প্রস্তুত করে যারা কোরবানী দিতে পারেনি তাদের তালিকা করা বিতরণ করা এবং রান্না করা মাংস পাড়াপড়শি সকলে এক সাথে বসে চাউলের রুটি দিয়ে খাওয়া যে কি আনন্দ ছিল সে সময় তা সত্যি ভাবনাতীত। এখানে গরীব ধনীর মাঝে কোন বিভেদ থাকেনা। সকলে মিলে এক সাথে একাকার। সামাজিক মেল বন্ধনের যে সংস্কৃতি তাঁর একটি বাস্তব চিত্র তেমনি ধর্মীয় শিক্ষা এবং ত্যাগের প্রভাবও এখানে লক্ষ্যনীয়।

ভোগ নয় ত্যাগ এবং অন্যের জন্য নিজের ধন, মান, অহংকারকে পদদলিত করে সাম্য ভালবাসা ও শান্তির যে বার্তা নিয়ে সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সেটির ও একটি বিরাট ইতিহাস রয়েছে যা হাজার বছর ধরে আমাদের সমাজে অন্ধকার হতে আলোতে পথ দেখিয়ে চলছে। এখানেই ধর্মীয় ব্যবস্থার সৌন্দর্য লক্ষ্যণীয়।

নিজের আমিত্ব, পশুত্ব, লোভ, লালসা ও অহংকারকে কোরবানী দেয়া অর্থাৎ পশু জবেহ করে পশুত্ব বিসর্জন দিয়ে শান্তির মেলবন্ধন তৈরী করাই “কোরবানী ঈদের” শিক্ষা। ত্যাগের মহীমায় উদ্ভাসিত করে সমাজব্যবস্থার যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন তিনি হলেন সকল ধর্মের আদিপিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) যিনি বাইবেলে আব্রাহাম বা আরাম (মহাপিতা), হিন্দু ধর্মে ব্রহ্মা। তাঁকে যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন সর্বসম্মতভাবে তিনি হলেন আমাদের ধর্মীয় সমাজব্যবস্থা নির্মাণের আদিপিতা বা আদিপুরুষ। খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় ২০০০ সালে অথবা আজ হতে ৪০৪৬ বছর পূর্বে ‘আহওয়ায়’ প্রদেশের “সুস” নামক স্থানে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন। সে সময়কালের সমাজব্যবস্থার যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় তিনি মেহমানদারিতে খুবই প্রসিদ্ধ ছিলেন। যার কারণে তঁাঁকে “আবুদদায়ফীন” অর্থাৎ মেহমানদের পিতা বলে আহ্বান করে সম্মানিত করা হতো।

বিবি সারাহ (রাঃ) গর্ভে হযরত ইছহাক (আঃ) এবং বিবি হাজেরার (রাঃ) গর্ভে হযরত ইসমাইল (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর পিতা আজর একজন কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। মূর্তি বানিয়ে বাজারে বিক্রি করাই ছিল তাঁর পেশা। ইতিহাসে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর পুত্রদের মধ্যে হযরত ইসমাইল এবং হযরত ইছহাক ছাড়াও আরো ১১ জন সন্তানের সন্ধান পাওয়া যায়।

হযরত ইব্রাহীম এবং তাঁর সন্তান হযরত ইসমাইল (আঃ) এর আত্মত্যাগ, ধৈর্য্য, একাগ্রচিত্ততা এবং সৃষ্টিকর্তার উপর অটল বিশ্বাসের যে ইতিহাস তৈরী হয়েছে সে শিক্ষা ব্যবস্থাকে অনুসরণই হলো আমাদের আজকে ‘ঈদুল আযহা’ বা কোরবানীর ঈদ।

গোটা ইসলামীয় দুনিয়া ‘হিজরি’ বর্ষপঞ্জির জিলহজ্ব মাসের ১০, ১১ এবং ১২ তারিখে বাৎসরিক ঈদউলআযহা বা ‘বকরিঈদ’ পালিত হয়। এই উৎসবটি কোরবানী নামে সমাধিক পরিচিত। কোরবানী শব্দের অর্থ হল উৎসর্গ করা।

হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এবং হযরত ইসমাইল (আঃ) এর আত্মত্যাগ এবং মাতা হযরত হাজেরা (রাঃ) এর ধৈর্য পরবর্তীতে পৃথিবীর একটি সভ্যতা, একটি নগর ও একটি শহর উপহার পেয়েছে যা ইতিহাস প্রসিদ্ধ ‘মক্কা নগরী’ এবং যা আরবী সভ্যতা হিসেবে সমধিক পরিচিত।

সে সময়কাল এবং হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এবং ইসমাঈল (আঃ) এর কোরবানীর শিক্ষাকে মানব সভ্যতার মাঝে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইসমাইল (আঃ) এর বংশ হতে আগত সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মানবতার পথ প্রদর্শক বিশ্বের জন্য আলোর দিশারী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর মাধ্যমে তা ধর্মীয় শিক্ষার সাথে ধর্মীয় কালচার বা সংস্কৃতির মাঝে স্থান করে নিয়েছে। আজকে বিশ্বের দু’শত কোটির অধিক মানুষ শ্রদ্ধার সাথে এ ব্যবস্থাকে পালন করে আসছে। এছাড়া হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এবং হযরত ইসমাইল (আঃ) ও হযরত হাজেরা (রাঃ) এর সে সময়কার ত্যাগ ধৈর্য ও কষ্টসহিষ্ণুতাকে স্মরণ করে ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হজ্বের আনুষ্ঠানিকতার মাঝে অনুসরণ করার যে নিয়ম প্রবর্তিত হয়েছে নিয়মিত তাঁদেরকে সম্মানের সাথে স্মরণ করা হয়।

আদি ধর্মীয় দৃষ্টির বাইরেও বাংলার সমাজব্যবস্থায় আদিকাল হতে কোরবানী ঈদের যে সৌন্দর্য তা ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে সর্বজনীনতার শিক্ষা হিসেবে আমাদের সমাজব্যবস্থার অংশ হয়ে রয়েছে।

পবিত্র ঈদুল আযহা বা কোরবানী ঈদকে সামনে রেখে ধর্মীয় শিক্ষা বাস্তবায়ন, মানবতার উন্নত আদর্শ প্রদর্শন করা জরুরি। সকল হিংসা, দ্বেষ, লোভ, লালসাকে পরিত্যাগ করে মানুষ মানুষের জন্য এ শিক্ষার বাস্তবায়নে সমাজের সচ্ছল লোকদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। আমরা যদি কোরবানীর প্রকৃত শিক্ষাকে অনুধাবন করে এ শিক্ষাব্যবস্থাকে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুকরণ ও অনুসরণের শিক্ষা দিতে পারি তবেই আমাদের ভিতরে জমে থাকা পশুত্ব, লোভ, অহংকার, আত্মম্ভরিতা, মিথ্যা এবং সামপ্রদায়িকতা হতে অবশ্যই মুক্ত হতে পারব। ভালবাসা, শান্তি, নিরাপত্তা, পরম সহিষ্ণুতার শিক্ষাই আমাদেরকে শান্তির পথ দেখাবে। সকলের প্রতি ভালবাসা, কারো প্রতি ঘৃণা নয়। এ হৌক আজকে ঈদে আমাদের অঙ্গীকার।

ইসলামের সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়েই আমরা একটি সুন্দর সহাবস্থানের সমাজব্যবস্থা প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে পারব। আবারো বলব, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এ স্লোগানই হোক আমাদের আজকের কোরবানী ঈদের মহাশিক্ষা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদকশিল্পশৈলী

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামবাসীর ভরসা হয়ে উঠছেন জনতার মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন
পরবর্তী নিবন্ধ‘লেখাটাকে আনন্দের বিষয় করে নিতে হবে’