দেশে ভূমি হস্তান্তরের দলিল নিবন্ধন হচ্ছে ১৯০৪ সালের রেজিস্ট্রেশন আইনে। এ আইন অনুযায়ী ভূমি নিবন্ধনের দায়িত্ব সাব-রেজিস্ট্রারের। তবে জমি নিবন্ধনের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রায় সব কার্যক্রমই পরিচালিত হয় সরকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় থেকে। এর মাঝখানে দলিল সম্পাদন ছাড়া আইন ও বিচার বিভাগের আওতাধীন সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের অন্য কোনো দায়িত্ব নেই। এতে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে সেবাগ্রহীতাদের। দুর্ভোগ লাঘবে সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেয়ার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে এ খবর প্রকাশিত হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে এ বিভাগ। তবে আইন বিভাগের অধীনে এ ধরনের বিভাগ নেই। কোনো কোনো দেশে এটি রাজস্ব মন্ত্রণালয়ের অধীন, আবার কোন কোন দেশে এটি গৃহায়ণ মন্ত্রনালয় রুরাল ও আরবান বিভাগের অধীনে রয়েছে। যেখানেই এটি থাকুক না কেন, ভূমি-ক্রয় বিক্রয় থেকে শুরু করে রেজিস্ট্রেশন পুরো প্রক্রিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি মন্ত্রণালয় দেখভাল করে। বাংলাদেশের মতো ১৯০৮ সালের রেজিস্ট্রেশন আইনে পরিচালিত হলেও সেটিকে তারা আধুনিকায়ন করেছে। আমাদের এখানে ভূমি ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজেশন করার প্রক্রিয়া শুরু হলেও সম্পন্ন হয়নি সেটি।
১৯০৮ সালে রেজিস্ট্রেশন আইনের ৪৯ ধারায় বলা হয়েছে ‘যেসব দলিলের রেজিস্ট্রেশন আবশ্যক তাহা যদি রেজিস্ট্রি না হয়, তাহা হইলে উক্ত দলিল দ্বারা সংশ্লিষ্ট সম্পত্তিতে বর্তমান বা ভবিষ্যৎ কোন প্রকার অধিকার বর্তাইবে না এবং দত্তক গ্রহণের ক্ষমতা নিবে না। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে রেজিস্ট্রেশন কতটা গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, এ রেজিস্ট্রেশন করেন একজন সাব-রেজিস্ট্রার। তিনি আইন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন। মোগল আমলে কানুনগো রাজস্ব নির্ধারণ ও রাজস্বসংক্রান্ত সব কাগজপত্র যেমন সংরক্ষণ করতেন তেমনি তিনি আবাদি জমি, পতিত জমির পরিমাণ, বিভিন্ন ফসলের বিবরণ, ফসলের বাজার দর, রাজস্বের হার, আদায়ের পরিমাণ, ঘাটতির পরিমাণ ইত্যাদি সংরক্ষণ করতেন। এছাড়া তিনি জমি হস্তান্তরের দলিল, জমি সংক্রান্ত আদালতের ডিক্রি সংরক্ষণ, নিবন্ধন ও তার অনুলিপি প্রদান করতেন। অর্থাৎ মোগল আমলে তহসিল অফিস ও রেজিস্ট্রেশন অফিস একই ছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা ভূমি রেজিস্ট্রেশন ও ভূমি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। তহসিল অফিসে ভূমির প্রকৃতি ও মালিকানা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য থাকে কিন্তু রেজিস্ট্রেশন অফিসে ভূমি হস্তান্তর সংক্রান্ত তথ্য থাকে। ফলে কেউ যদি কোনো জমি রেজিস্ট্রি করার জন্য রেজিস্ট্রেশন অফিসারের কাছে উপস্থিত হয়, তাহলে ওই ব্যক্তিই যে জমির মালিক তা নির্ণয়ের কোনো উপায় থাকে না। ফলে একজন অনায়াসেই অন্যের জমি বিক্রি করে দিতে পারবে। সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে রেজিস্ট্রির জন্য উপস্থিত হলে তিনি জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হবেন যে তিনিই দলিল সম্পাদনকারী কিনা? (রেজিস্ট্রেশন আইন ধারা ৩৫)। রেজিস্টিকারী অফিসার দলিলে বৈধতা অথবা যথার্থতা প্রতিপাদন করতে পারবেন না।
বাংলাদেশের ভূমিকে কেন্দ্র করে একটি বিরাট সমস্যা হচ্ছে জবর দখল। প্রকৃতিগতভাবেই বাংলাদেশে বিশাল জনসংখ্যার অনুপাতে ভূমির পরিমাণ কম হওয়ায় এই সমস্যার উদ্ভব। সমস্যাটি জনগণের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাকে হুমকির সম্মুখীন করে তোলে। যা-ই হোক বর্তমানকালে সমস্যাটি প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়। কেউ যদি গায়ের জোরে অর্থের জোরে অন্যের ভূমি দখল করে, তাহলে সেই ভূমি মালিককে আইন কতটুকু রক্ষা করে? অধিকাংশ ক্ষেত্রে যারা বেআইনি দখলদার, তারা কিছু অর্থ খরচ করে কিছু জাল কাগজপত্র বের করে এবং এর ভিত্তিতে তারা অবৈধভাবে ভূমি দখল করে। অনেকে আবার জাল কাগজ তৈরি করারও প্রয়োজন মনে করে না। দখলচ্যুত ব্যক্তির দখল ফিরে পাওয়ার উপায় কী? তাকে দখল উদ্ধারের জন্য দেওয়ানি আদালতে যেতে হবে। এভাবে ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ ও মামলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ ভূমি অফিস এখনো পুরানো ধাঁচেই চলছে। জমি ক্রয় বিক্রয়, নামজারিসহ আরো অনেক বিষয়ে মানুষ নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। ভূমি সংক্রান্ত কত মামলা চলছে, তার সঠিক হিসাবও কারো কাছে আছে বলে মনে হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমি জরিপ ও নিবন্ধন ডিজিটালকরণের যেসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে, তাতে ভূমি সংক্রান্ত অনিয়ম দুর্নীতি পুরোপুরি কমবে না। শুধু কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে জমির পুরনো কাগুজে রেকর্ডপত্র স্ক্যান করে রাখলেই সার্বিকভাবে এর সুফল জনগণ পাবে না। ডিজিটাল পদ্ধতির সুফল নিশ্চিত করতে হলে ভূমির রেকর্ডসহ সব ধরনের তথ্য কম্পিউটারইজ করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে চলমান ভূমির রেকর্ডপত্র সংরক্ষণ, রেজিস্ট্রেশন, নকশা প্রণয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে জালজালিয়াতির কারণে ভূমি নিয়ে নানা ধরনের বিরোধ রয়েছে। তা বাড়ছেও আর এসব বিরোধের জের ধরেই চলে এখাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি। এটি দূর করতে ভূমি রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য জেলা রেজিস্ট্রার ও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ও দলিল লেখকদের কঠোর তদারকির আওতায় আনা, অফিসে আকস্মিক পরিদর্শন বাড়ানো, প্রতিবছর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হালনাগাদ আয় ও সম্পত্তির বিবরণ বাধ্যতামূলকভাবে প্রকাশ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসগুলোতে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের অফিস কর্তৃক নিয়মিত নিরীক্ষার ব্যবস্থা জেলা রেজিস্ট্রার ও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসগুলোতে অভিযোগ দায়ের ও নিস্পত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া এবং যথাযথভাবে গণশুনানির ব্যবস্থা করা, ভূমি নিবন্ধন সেবাকে ডিজিটালইজেশন করা এখন সময়ের দাবি। এ সংক্রান্ত আইনি ও পদ্ধতিগত সংস্কার এবং আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি। সর্বোপরি ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিসকে দ্রুত ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা প্রয়োজন।