দীর্ঘদিন ধরেই দেশের প্রথাগত উন্নয়ন ধারার বাইরে ছিল হাওড় অঞ্চল। জাতীয় উন্নয়নের নীতিকাঠামোর মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় ২০১২ সালে সরকার ২০ বছর মেয়াদে (২০১২-১৩ থেকে ২০৩১-৩২ পর্যন্ত) এ অঞ্চলের জন্য আলাদা উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৫৩টি প্রকল্পের মধ্যে আগাম বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা, মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, শস্য উৎপাদন, পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ, মৎস্য ও গবাদি পশুর উন্নয়ন, বনায়ন, পর্যটন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সড়ক ও নৌ চলাচল উন্নয়নসহ বিভিন্ন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত। মহাপরিকল্পনা ঘিরে কাজ চলছে এখনো। বাঁধ ও সড়ক নির্মাণ, কালভার্ট তৈরিসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে বটে, কিন্তু বন্যার পানিতে বীজতলা ভেসে যাওয়া বা হাওড়ের কৃষকের ধান চাষ সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর তেমন কোনো সমাধান দৃশ্যমান নয়। এর মধ্যে চলতি বছর চার দফা বন্যার কারণে সুনামগঞ্জের হাওড়গুলো এখনো পানিতে ভরাট। অনুন্নত ব্যবস্থাপনার কারণে পানি নিষ্কাশনের ধীরগতি বিদ্যমান। পানি থাকায় একদিকে বীজতলা তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না, অন্যদিকে নতুন করে বোরো ধানের আবাদ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি চালের বাজারেও অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। দেশে উৎপাদিত চালের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ আসে বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধান থেকে। উৎপাদিত এ ধানের শতকরা ২০ ভাগের উৎস হাওড় অঞ্চল। এখানে যে বছর বোরো ধানের ভালো ফলন হয় ও প্রাকৃতিক কোনো বিপত্তি বাদ না সাধে সে বছর চালের দামও ভোক্তাসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে। কিন্তু বিঘ্ন ঘটে আগাম বন্যা, পাহাড়ি ঢল কিংবা অতি বৃষ্টির কারণে। ভূ প্রকৃতিগত কারণে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর হাওড় অঞ্চলে আর ধান রোপণ বা চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না। শুধু প্রকল্প ও অবকাঠামো নির্মাণ করলে কার্যকর ফলাফল পাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন ও উদ্ভাবনী পদ্ধতির দিকে অগ্রসর হওয়া জরুরি। বছরের প্রায় ছয় মাস হাওড়ে পানি থাকে। পানি আসতে শুরু করে বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ থেকে। শেষ হয় আশ্বিন-কার্তিকে। বাকি কয়েক মাস এখানে শুষ্ক ঋতু। তাই এমন জাতের ধানের বীজ বপন করতে হবে, যা হাওড়ের শুষ্ক মৌসুমের মধ্যেই তুলে ফেলা সম্ভব হয়। এ অবস্থায় হাওড় অঞ্চলের জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে তিনটি ধাপে পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার অধীনে স্থানীয়দের মধ্যে বিশেষ জাতের ধান সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির মতো কর্মসূচি নিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে ধানের বীজের সরবরাহ। ভালো ফলনের জন্য নির্ধারিত সময় বীজতলা তৈরি ও বপনবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান জরুরি। গুরুত্ব দিতে হবে ভাসমান সবজি চাষের দিকেও। মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতির আওতায় ধান উৎপাদন কৌশল সম্পর্কে কৃষকদের প্রশিক্ষিত করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া বন্যার আগাম পূর্বাভাস পেতে আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমের (ইডব্লিউএস) উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এমন ধরনের বীজ ব্যবহার করতে হবে যা দ্বিগুণ ফলন দিতে সক্ষম। স্বল্পমেয়াদি উচ্চ ফলনশীল ধান উদ্ভাবন করতে হবে। সেচের পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা ফলপ্রসূ হবে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে বিভিন্ন জাতের উচ্চ ফলনশীল বীজ উদ্ভাবনের দিকে যেমন মনোযোগ দিতে হবে, তেমনি ফসল তোলার ক্ষেত্রে সনাতনী পদ্ধতির বদলে আধুনিক পদ্ধতি ও যন্ত্রের প্রচলন ঘটাতে হবে। জমি থেকে কৃষকরা যাতে দ্রুত ফসল তুলে নিতে পারেন সেজন্য নিমজ্জনযোগ্য সড়ক তৈরির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত দেশগুলোতে ডেটা ও মডেলের সমন্বয়ে বন্যার পূর্বাভাস ও গতিপ্রকৃতি নিরূপন করে আগাম প্রস্তুতি নেয়া হয়। হাওড়ের অতিবন্যা মোকাবেলায় আমাদেরও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দিকে অগ্রসর হতে হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি পানি উন্নয়ন বোর্ড হাওড় ফসল রক্ষা কমিটিসহ সব অংশীজনকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরাও ধারণা করেছেন ১০-১৫ বছর পর বৃষ্টির পরিমাণ আরো বাড়বে। এতে স্বাভাবিকভাবেই বন্যা ও জলাবদ্ধতা সংকট হাওড়াঞ্চলে আরো বাড়বে। এ অবস্থায় আমাদের উচিত হবে বন্যা নিয়ন্ত্রণে পুরনো চিন্তা থেকে বেরিয়ে যুগোপযোগী ও টেকসই ব্যবস্থা নেয়া। শুধু বন্যা নিয়ন্ত্রণ নয় বন্যা ব্যবস্থাপনায়ও মনোযোগ দিতে হবে। যেখানে জলাবদ্ধতার আশংকা আছে, সেখানে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। ভূ-প্রকৃতিগত কারণে হাওড়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ কার্যকর নয়। বদলাতে হবে বাঁধের নির্মাণ প্রকৌশল। অভিযোগ আছে সময়মতো ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ না হওয়া, প্রয়োজনের তুলনায় বাঁধগুলোর উচ্চতা কম হওয়ার কারণে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। হাওড় অঞ্চলে যে স্লুইচগেটগুলো রয়েছে তার নকশা ১৯৭০ সালের। পুরনো এ গেটগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে তেমন কাজ করছে না। তাছাড়া কোথাও কোথাও বঙ কালভার্ট নির্মাণের কারণে বন্যার পানি আটকে থাকছে। তাই বন্যার পানি দ্রুত অপসারণ করতে এলাকার স্লুইচগেট কালভার্ট ও অপ্রয়োজনীয় বাঁধগুলোর অপসারণ করতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে পলি পড়ে হাওড়ের তলদেশ ভরাট হওয়া, খালগুলোর নাব্যতা কমে যাওয়া এসব বিষয়ে।