ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৭–১৮৯৪)। শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক। তিনি ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ শে ফেব্রুয়ারি কলকাতার হরীতকীবাগান লেনে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার সংস্কৃত কলেজে কিছুকাল অধ্যয়নের পর ভূদেব ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। হিন্দু কলেজে অধ্যয়ন শেষে তিনি হিন্দু হিতার্থী বিদ্যালয়ের (১৮৪৬) প্রধান শিক্ষকরূপে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পর তিনি ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে সহকারী স্কুল ইন্সপেক্টররূপে যোগদান করেন। ১৮৮৩ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিসের জনশিক্ষা পরিচালক পদে যোগদান করেন এবং উইলিয়ম হান্টারের শিক্ষা কমিশনের সদস্য মনোনীত হন। তিনি ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে দীর্ঘ পাঁচ বছর শিক্ষাবিষয়ক মাসিক পত্রিকা শিক্ষাদর্পণ ও সংবাদসার পরিচালনা করেন এবং ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে সরকারি পত্রিকা এডুকেশন গেজেট (১৮৫৬)-এর সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ভূদেব মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা গদ্যের বিশিষ্ট শিল্পী। তিনি বাংলা গদ্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থগুলো–পারিবারিক প্রবন্ধ (১৮৮২), সামাজিক প্রবন্ধ (১৮৯২), আচার প্রবন্ধ (১৮৯৫), বিবিধ প্রবন্ধ (১৮৯৫) ইত্যাদি। প্রথম তিনটি গ্রন্থে তিনি হিন্দুদের আচার–আচরণ, ধর্মনীতি ও পারিবারিক বিধিবিধানকে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। তিনি ছাত্রদের পাঠোপযোগী অনেক গ্রন্থও রচনা করেছেন। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: প্রাকৃতিক বিজ্ঞান (২ ভাগ, ১৮৫৮–৫৯), পুরাবৃত্তসার (১৮৫৮), ইংল্যান্ডের ইতিহাস (১৮৬২), রোমের ইতিহাস, ক্ষেত্রতত্ত্ব (১৮৬২), বাংলার ইতিহাস (৩য় ভাগ, ১৯০৪), পুষ্পাঞ্জলি (১ম ভাগ, ১৮৭৬) ইত্যাদি। তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাস (১৮৫৭) বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসের দ্বিতীয় নিদর্শন। এর মধ্যে ‘সফল স্বপ্ন’ ও ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’ এ দুটি আখ্যান সন্নিবিষ্ট হয়েছে। দ্বিতীয় আখ্যানটির উৎস একটি ইংরেজি কাহিনী হলেও শেষ পর্যন্ত তা মৌলিকত্ব অর্জন করেছে। তাঁর শিক্ষাবিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৬) শিক্ষাতত্ত্বসার সমৃদ্ধ একটি রচনা। স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৮৯৫) গ্রন্থে তাঁর ইতিহাসবোধ, স্বদেশপ্রীতি এবং কল্পচেতনার এক অনবদ্য সমন্বয় ঘটেছে। ভূদেব মুখোপাধ্যায় ছিলেন উনিশ শতকের বিশিষ্ট মনীষী এবং বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ। সাহিত্য, ধর্মশাস্ত্র, সমাজ, শিক্ষা, ইতিহাস, বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর গভীর পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর মেলে। তাঁর কর্মের সম্মাননাস্বরূপ ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি সরকার কর্তৃক সি.আই.ই উপাধি লাভ করেন। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।