ভূত আর ডাইনির সাথে রাত

রেজাউল করিম | বুধবার , ৩ নভেম্বর, ২০২১ at ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ

‘ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি, রাম-লক্ষণ বুকে আছে, করবি আমায় কী?’ ভূতে বিশ্বাস না করলেও, ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ অনেকের গা ছমছম করে। ‘এই ভূত সেই ভূত, ভূতে কতো ভয়/ ন্যাকা সুরে কথা বলে, জানো পরিচয়/ বড় অদ্ভুদ কিম্ভূত, ভূতে কতো রূপ/ ভয় পেয়ে গিন্নী, জ্বালে দেখ ধূপ/ কেউ বলে কদাকার, দেখে যায় মূর্ছা/ আজগুবি রটে কিছু, ঝাড় ফুকে খরচা/ ভূত যে ভালো নয়, এই কথা সত্যি/ মিলে যদি গেল কিছু, এতোটুক রত্তি/ ভূত আছে ভূত নেই, এই নিয়ে দ্বন্দ্ব/ ঘাড়ে যদি ভূত চাপে, আর নেই সন্দ (সন্দেহ)।’ অমাবস্যার রাত হলে তো কথাই নেই। দূর থেকে শুধু বাতাসের হু হু আওয়াজ। হঠাৎই চারপাশে নেমে এলো ঘোর অন্ধকার। এক টুকরো মেঘ এসে ঢেকে দিলো রূপালি চাঁদকে। দপ্‌ করে নিভে গেলো টেবিলে রাখা মোমবাতি। দরজায় ঠক্‌ ঠক্‌- কে যেন এসেছে। কে এলো এই রাতে? ওরে বাপরে, লম্বা টুপি মাথায়, হাতে উড়ন্ত ঝাড়ু নিয়ে দাঁড়িয়ে নাক বাঁকানো হ্যালোইন ডাইনি।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কারণে ভূত বা ডাইনির দেখা মেলে না। ‘আজকালকার ভূতগুলো সব/ এমন ধারা পাজি/ মোবাইলেও আড়ি পেতে/ করে যে কারসাজি/ কম্পিউটার হ্যাং করে দেয়/ মাউস দিশেহারা/ কী-বোর্ডে সব নবগুলিও/ যেন পাগলপারা/ এসব দেখে বলল সেদিন/ ভূতের দেশের দূত/ বিজ্ঞানীকেও হার মানাবে/ এই শতকের ভূত/ এই শতকের ভূত! থাকে কোথা/ কোথায় তাদের বাড়ি/ হি হি হেসে বলল সে দূত/ দিলেম তোমায় আড়ি।’ কিন্তু মিথ বা বিশ্বাস এখনো আছে। সেজন্য প্রতিবছর ৩১ অক্টোবরের শেষ রাতে হ্যালোইন উৎসব উদযাপন করা হয়। এই রাতে মৃত আত্মাদের স্মরণে পালিত হয়। দুই দশক আগেও প্রাচ্যে হ্যালোইনের তেমন পরিচিতি ছিল না। তারকাখচিত হোটেলগুলো দিনটিকে প্রাচ্যে উৎসবমুখর করে তুলেছে অনেকে মনে করেন। তবে পাশ্চাত্যে যথারীতি দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। ৩১ অক্টোবর মৃতের দেবতা সব মৃত আত্মাদের পৃথিবীতে আহ্বান জানান। ওইদিন উড়ন্ত ঝাড়ুতে করে হ্যালোইন ডাইনি উড়ে বেড়ায় আকাশ জুড়ে। কখনওবা সবুজ খরখরে দেহের ডাইনি বুড়ি কড়া নাড়ে কোনো বাড়ির দরজায়। হ্যালোইনের দিনটি সম্পর্কে লোকজ ধারণা এটি। এবার আসি উৎসব প্রসঙ্গে, হ্যালোইন উৎসব পালনের শুরুটা ছিলো মধ্যযুগে। আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ডের উচ্চ ভূমি ও ফ্রান্সের উত্তর অংশ জুড়ে তখন কেল্টিক সভ্যতার বিস্তার। প্রাচীন কেল্টদের পালিত সামহাইন উৎসব থেকেই মূলত হ্যালোইনের সূত্রপাত। কেল্টদের বছর শুরু হতো ১ নভেম্বর থেকে। গ্রীষ্ম ও ফসলি মাসের শেষ ও শীতের শুরু। কেল্টদের বিশ্বাস ছিলো, নতুন বছর শুরু হওয়ার আগের রাতে জীবিত ও মৃতের দুনিয়ার মধ্যকার ফারাক কেটে যায়। সেসময় মৃত আত্মা ও ভূত-প্রেত পৃথিবীতে আসে। সেজন্য অক্টোবরের শেষ রাতে মৃত স্বজনদের আত্মার সঙ্গে মিলনের কামনায় তারা সামহাইন উৎসব পালন করতো। পরে এ ভূত উৎসবে খৃষ্ট ধর্মের প্রভাব পড়ে। বিশ্বব্যাপী ১ নভেম্বরকে ‘অল সেইন্টস ডে’ ঘোষণা করা হয় ও এর আগের সন্ধ্যাকে ‘অল-হ্যালোস-ইভ’ বা হ্যালোইন হিসেবে পালিত হয়। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে আমেরিকায় জাতীয়ভাবে হ্যালোইন ডে পালিত হতে থাকে। ১৯২০ থেকে ১৯৫০ সালের ভেতর পুরো আমেরিকায় হ্যালোইন ডের আনুষ্ঠানিকতা বাড়তে থাকে। পরে দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গণ্য করা হয়। এদিন সবাই ভূতের সাজে নিজেকে সাজায়। অনেকের মতে, এসময় সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে যায় বিদেহী আত্মারাও। এ দিনটিকে ঘিরে পুরো অক্টোবর মাসব্যাপী চলে আয়োজনের ঘনঘটা। কুমড়োর লণ্ঠন তৈরি, বাড়িঘর-রাজপথ সাজানো ও চকলেট-পেস্ট্রি তৈরিতে ব্যস্ত থাকে আয়োজকরা। বর্তমানে আমেরিকায় শুধু নয়, সমগ্র বিশ্বে হ্যালোইন ডের বাণিজ্যিক গুরুত্বও রয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ফি-বছর হ্যালোইন ডে উৎসবে খরচ করে প্রায় ১১-১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিংশ শতাব্দীতে এসে ধীরে ধীরে নানা রকমের অদ্ভুত পোশাক বা কস্টিউম পরে হ্যালোইনের রাতে ঘুরে বেড়ানোর রীতি প্রচলিত হয় ইংল্যান্ডে। একই সময়ে প্র্যাংক বা কাউকে বোকা বানানোর খেলাও শুরু হয় ইংল্যান্ডে, যেটি কি না আরো দুইশ’ বছর আগেই স্কটল্যান্ডে হতো। তারা বিভিন্ন রকমের জিনিসে খোদাই করে মুখমণ্ডল আঁকতো, আর ভেতরটা ফাঁপা করে আলো জ্বালানো হতো। এ লণ্ঠনগুলো আত্মার বহিঃপ্রকাশ আর প্রেতাত্মা তাড়াবার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতো আইরিশরা, আর স্কটিশরা ঊনিশ শতক থেকেই মিষ্টি কুমড়াকে (কিংবা অন্য বড়সড় সবজি) ফাঁপা করে খোদাই করার প্রচলন হয় সমারসেটে বিংশ শতকে, যা ধীরে ধীরে পুরো ইংল্যান্ডেই ছড়িয়ে যায়। একে বলা হয় জ্যাক-ও-ল্যান্টার্ন কিংবা উইল-ও-দ্য-উইস্প।
হ্যালোইনের রাতে শিশুরা ট্রিক অর ট্রিট খেলে থাকে। যদি ট্রিট না দেয় কোনো বাসার মালিক, তবে তার উপর কোনো ট্রিক খাটানো হবে, যা শুভ কিছু হবে না। ইউরোপে একটি প্রথা ছিল এই ট্রিক অর ট্রিট, অবশ্য তখন এর নাম ছিল মামিং। ট্রিক অর ট্রিট এখন পশ্চিমা বিশ্বে জনপ্রিয়। ভূতের সাথে শিশুরা বেশ মজা করে রাত কাটায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআলাদা
পরবর্তী নিবন্ধমোবাইল ফোন চুরি ঘটনায় ব্যবস্থা নিচ্ছে না পুলিশ