ভূগোলের গোল

ডা: কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২৫ জুলাই, ২০২৩ at ৮:০৭ পূর্বাহ্ণ

সময়ের কথন : হায় বার্মা!

আমার বাড়ির সামনে এক দীঘি আছে। বেশ বড়। নাম হাধুর দীঘি। স্বচ্ছ নীল জল। পাড়গুলোর চারপাশে অসংখ্য গাছ আর পুরো এলাকার কবরস্থান। গ্রীষ্ম বা শরতের বিকেলে দীঘির পাড়ে বুড়োবুড়িরা গল্প করতেন। কখনো নিজেদের মাঝে, কখনো বাচ্চা ও তরুণদের মাঝে। এই বুড়োদের অধিকাংশই বার্মাফেরত। জীবনের প্রডাকটিভ সময়টা তারা বার্মায় কাটিয়েছেন, কাজেই গল্পের বিষয়বস্তু বার্মার জীবন, বার্মায় কর্মজীবনের হাসিকান্না নিয়ে এরা গল্প করত। তখন তো রেডিও, টিভি ছিল না। কাজেই ছোট বড় সবারই বিনোদনের মোক্ষম বিষয় ছিল আড্ডা। আমি আরো অনেকের সাথে মন দিয়ে বুড়োদের গল্প শোনতাম। যৌবনের প্রবাহে বুঝতে শুরু করলাম কোথায় বার্মা, কোথায় রেংগুন, কোথায় আকিয়াব, আর মানদালয়। রেংগুনকে কেন রংগিলা শহর বলে বুড়োদের গল্পে তাও আঁচ করতে পেরেছিলাম।

এখন মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে লোকজন যে সব চাকরি করে রেংগুন গিয়েও মানুষ তা করত। দুচারজন ব্যবসা, ঠিকাদারী করত। সোজা চাকরি ছিল জলযান, লঞ্চস্টীমার খালাসী, সুকানী, সারেং এর চাকরি। যেহেতু বিস্তর ভারতীয় চেন্নাই, কোচিন, মুম্বাই, কোলকাতা, চট্টগ্রাম থেকে বার্মা যাতায়াত করত সেহেতু জাহাজের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম এর লোকের চাকরির মনোপলি ছিল। শিল্পপতি একে খান সাহেবের শ্বশুর ফটিকছড়ির আবদুল বারী চৌধুরী প্যাসেঞ্জার শিপিং শুরু করলে চট্টগ্রামের তাবৎ তরুণের বার্মায় চাকরির অভাব হত না। মাবাবার সাথে অভিমান করে ১২১৪ বছরের ছেলে পালিয়ে সদরঘাটের জাহাজঘাটায় বসে কাঁদছে। এলাকার কোন লোক তাকে সোজা জাহাজে তুলে একেবারে আকিয়াব বা রেংগুন। কাজে যোগ দেয়ার আগে জাহাজের এজেন্ট নজির আহমদের ছয়তলা বিল্ডিং এ ১০১২ দিন ফ্রি খাওয়া, থাকা, পুরো রেংগুন থেকে আকিয়াবের রেললাইনের দু পাশে সমস্ত ধানী জমির পাশে আবদুল বারী চৌধুরীর ডজনে ডজনে ধানের মেশিন। এসব মেশিনে প্রচুর লোক কর্মী লাগত। চট্টগ্রামের অধিকাংশ লোক ধানের মেশিন ও ছোটলাইটার জাহাজে চাকরি করত। তারা হয়ত ভাল আয় জমাতে পারত। কারণ দেশে আসলে বার্মার টাকায় জমিজমা, ঘরবাড়িনতুন করা বেশ স্বাচ্ছন্দেই করতে পারত। অনেকে আসার সময় বার্মিজ তরুণী বিয়ে করে নিয়ে আসত। আমার পাড়ায় ৪৫ জন বার্মিজ বউ ছিল। মজার ব্যাপার হল ওই বার্মিজ মহিলারা বিদেশ বিভুইয়ে একজন আরেকজনের বাড়িতে ‘নাইয়র’ করত। এই বার্মিজ মহিলাগুলো সতেজযৌবনা, উজ্জ্বলআনন্দে ভরা। কারো সাথে ঝগড়াও করত না। ঘরে প্রায়ই বাঙালি সতীন থাকত। সতীনের সাথেও বোনের মত জীবন কাটাত। আমি পাড়ার এই বার্মিজ বৌ গুলোকে দাদি ডাকতাম। তাদের কোমরে চাবি বাঁধা থাকত। মজার খানা তারা আলমারি থেকে খুলে নাতিনাতনীদের খেতে দিত।

আমাদের এলাকায় খাওয়াদাওয়াতে ও বার্মিজ কৃষ্টিঐতিহ্য ছড়িয়ে পড়ে। যেমন হরেক রকমের বিনি ভাতের নাস্তা। এই নাস্তাগুলো বানানোর জন্য বার্মায় স্পেশাল “ফ্রাইপেন” পাওয়া যেত। “ফ্রাইপেনের” ঢাকনাতে কয়লা দিয়ে বেকিং করার সিস্টেম থাকত। এই খাবারগুলো আসলেই মজার ছিল। পাড়ার বিয়েতে তখন শুধু সাদা ভাত আলুগোস্ত, ডাল মাটিতে সতরঞ্জি বিছিয়ে খাওয়ানো হতো। বরের বাবা ও বন্ধুবান্ধবদের জন্য ১০২০ জনের কোরমা, মুসাল্লাম সার্ভ করা হত। কিন্তু তখন বাবুর্চি, ডেকোরেশন কিছুই ছিল না। পাড়ার বার্মিজ মহিলাদের মধ্যে দু’জনকে বিয়ে বাড়িতে কোরমা, মুসাল্লাম রান্নার জন্য ‘হায়ার’ করে নিত। এই দুজন অত্যন্ত সুস্বাদু কোরমা, মুসাল্লাম রাঁধতেন। তাদের সম্মানী ছিল একটা সুতী সাদা শাড়ি, দুই আনার (টাকার ১/৮ ভাগ) পান, দুই আনার সুপারী।

এলাকার দুজন ধনাঢ্য ব্যক্তি অধ্যক্ষা রওশন আকতার হানিফের নানা আরবান আলী সওদাগর ও নজির আহমদ হেডম্যান, পরবর্তী জন আমার দাদা দুজনই এলাকায় মসজিদ, স্কুল, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে দুজন একত্রে চাটার্ড লঞ্চে আকিয়াব থেকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর মোহনা হয়ে হালদা নদী দিয়ে সোজা আরবান আলী সওদাগরের ঘাটবরাবর ঘরের ফার্নিচার বোঝাই লঞ্চ নিয়ে আসতেন। এই ফার্নিচারগুলোর বয়স ১০০ বছর বা তার বেশি। পোকাও ধরে না, রংও যায় না। আমার দাদার আমলের একটা বেতের চেয়ার আছে। উনি ওটায় বসে হুক্কা টানতেন। এই চেয়ারের বয়সও একশ বছর হবে। ভয়ে কেউ ওটাতে বসে নাযদি বেত ছিড়ে যায়। দুজনের ঘরেই বার্মিজ বড় বড় পিতলের ডেক, বসার সতরনজি, প্লেট ছিল। আনুমানিক শ তিনেকের খাবার সরঞ্জাম ছিল। তখন কেউ মেজবান দিলে নজির আহমদ ও আরবান আলী সওদাগরের খাবার সরঞ্জাম নিত। মাইজভাণ্ডারের ওরশেও ডেকোরেশন আসার আগ পর্যন্ত এই দুই পরিবারের ডেক নেওয়া হত। দুজনই বার্মা থেকে দেশে আসলে পাড়ার অনাত্মীয়দের জন্যও কাপড় আনতেন। নজির আহমদ দেশে কোন জায়গা জমি কিনতেন না। উনি বলতেনআমার একটা ছেলে। সেও বার্মা চলে যাবে। জায়গা জমির ঝামেলাতে আমি নাই। নজির আহমদ সৌখিন মানুষ ছিলেন। লুঙ্গীও ইস্ত্রী করে পরতেন। লুঙ্গীর সাথে স্যুমোজাও সবসময় পরতেন। তার ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠলে ছেলের লেখাপড়ায় ‘মন’ বসার জন্য বার্মা থেকে একটা গ্রামোফোনও আনেন। সাথে সায়গল, শমিসাদ কোমরে ফিল্মী গানের রেকর্ড। বিয়েপূর্ব রাতে উঠানে গ্রামোফোন (বলা হত কলের গান) এর চারপাশে ছেলেমেয়ে সবাই বসে গান শুনত। রেংগুন ও ইংরেজ কালচারে নজির আহমদ এতই অনুরক্ত ছিলেন যেএকমাত্র ছেলে ও মেয়েকে চিড়ামুড়ি, পিঠা খেতে দিতেন না। প্রতি ১৫ দিন অন্তর ইউরোপীয়ান ‘স্ল্যাক প্যাকেট’ পাঠাতেন। পাড়ার মুরব্বীরা বুদ্ধি দিল যে একটা সাইকেল কিনে দিলে ছেলের মন ভাল থাকবে। ছেলে তখন ক্লাস সিঙ এ। নজির আহমদ সেই ১৯৩৮ সালে ছেলেকে বার্মা থেকে একটা ‘হারকিউলেস’ সাইকেল কিনে আনল। সাইকেল পেয়ে ছেলের ‘চৌচৌ’ করে ঘোরা আরো বেড়ে গেল।

বার্মা ছেড়ে যেতে হবে এটা আমাদের এলাকার লোকজন দিবাস্বপ্নেও ভাবেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানীরা বার্মা দখল করলে বার্মায় চট্টগ্রামের লোকজনের ধনসম্পত্তি সব ধ্বংস হয়ে যায়। বার্মিজরা নৃশংসভাবে বাঙালি হত্যা ও সম্পদ লুঠে মত্ত হয়। অনেকে শুধু এক লুঙ্গী পরে কপর্দকহীন অবস্থায় দেশে ফিরে। পুরো এলাকায় দুর্যোগ অভাব নেমে আসে। অনেক লোক ১২ বৎসর বয়সে বার্মা গিয়েছে। ৬০ বৎসর বয়স পর্যন্ত একবারও দেশে আসেনি। প্রাণের ভয়ে এসব লোকও দেশে ফিরে এসেছে। এদেরকে আমরা ছোটরা বার্মাবুইজ্যা (বুড়ো) ডাকতাম। বিশ্বযুদ্ধের পর বার্মার জাতীয়তাবাদী সরকার বাঙালিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি সরকারিভাবে বাজেয়াপ্ত করে। কিছু বাঙালি ও গুজরাটি সমস্ত বিপদ মেনেও রেংগুনসহ বড় বড় শহরে থেকে যায়। তারা মোটামুটি এখনো বর্মী নাগরিক হিসেবে সুবিধা ভোগ করছে। পঞ্চাশের দশক থেকে ‘বার্মাফেরতের’শোক ফিকে হতে থাকে। আমার এলাকার মানুষ আবার ভাগ্যের অন্বেষণে ছুটে যায় নতুন দেশে। এই নতুন শহর এবার করাচী, আবার বাড়িঘর খালি হতে থাকে। নতুন সূর্যের স্বপ্নে করাচী যাহা চলে দু্‌ই যুগ।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বস্তির নিঃশ্বাস ও একটুকরো সবুজের জন্য নগরবাসীর প্রত্যাশা
পরবর্তী নিবন্ধমীরসরাইয়ে সাপের কামড়ে যুবকের মৃত্যু