ভূগোলের গোল

একুশের ভোর প্রহরে

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

হায়দার হাসান বাবুর অনবদ্য ৯০ এর দশকের গানের একটি কলি ‘তিরিশ বছর পরেও স্বাধীনতা তোমাকে খুঁজছি।’ আসলে গতকাল আর আজ এক নয়। আজ আর আগামীকালও এক হবে না। ৭০৭১ এর উত্তাল দিনযেগুলো ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের Formative days (প্রস্তুতিমূলক সময়) তখন আপামর জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা ছিল বৈষম্যহীন ও শোষণহীন সমাজব্যবস্থা। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রেও এরকম সমাজব্যবস্থার উল্লেখ আছে। আবার আমরা যদি আরো পিছে যাই অর্থাৎ ৫২ থেকে ৬৯তখন ভাষার আন্দোলনই স্বাধীনতা যুদ্ধের ভিত্‌ গড়ে তোলে। যে জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দেয়, যে জাতি ৫২ থেকে সত্তুর রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বলে রাজপথ উত্তাল করেছিল আজ সত্তর বছর পর বাংলা ভাষার সামাজিক ও মনস্তাত্বিক অবস্থান বিস্তৃত গবেষণার সম্মুখীন। বাংলাভাষী মানুষের একমাত্র রাষ্ট্র আমাদের স্বদেশ। এখানেও সর্বস্তরে বাংলা চালু হয় আইনগতভাবে ১৯৮৭ সালে এক অধ্যাদেশ মূলে অর্থাৎ স্বাধীনতার ১৬ বছর পর রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। এটা নিয়েও কারো কোন বক্তব্য থাকার কথা নয়। সমস্যাটি হচ্ছে ৫২ এর ৭০ বছর পরে বাংলা সামাজিক ও আত্মীকভাবে ব্যাকফুটে চলে গিয়েছে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ ও ১৯৪৭ সালে আবারো বঙ্গভঙ্গ যেমন বাংলাভাষী মানুষের ইতিহাসে এক বিরাট প্যারাডকস্‌্‌ তেমনি ভাষায় জীবনদানকারী জনগোষ্ঠীরা কিভাবে এত বেশি বাংলাকে অবহেলা, অবজ্ঞা করছে তা এক বিস্ময়ের ব্যাপার অন্ততঃ আমার কাছে। এখানে ইংলিশ প্রীতিটা বিবেচ্য নয়বাংলা ভাষার প্রতি উদাসীনতাই বেদনাদায়ক।

একুশেকে খুঁজতে চট্টগ্রাম শহরে ঘুরেছি। যে একুশেকে আমি ‘পদযাত্রায়’ দেখেছি তা এক মিশ্রিত অভিজ্ঞতা, সরকারীবেসরকারী [বেসরকারী স্কুলে বাংলা মিডিয়াম নগন্য] স্কুলে আশে পাশে কিছু পথ নগ্নপদে মিছিল। সামনে শুধু স্কুলের নাম, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা বিষয়ক একটি ব্যানার, স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই শ্লোগানে মুখরিত হত। বিভিন্ন ব্যানারে ভাষাভিত্তিক পদাবলীর পংক্তিযুক্ত প্লাকার্ড, পোস্টার ইত্যাদি থাকত। স্কুলের ভিতরে একুশ নিয়ে কিছু আবৃত্তি, বক্তৃতা হয়। কিন্তু অধিকাংশ স্কুলেই অন্য যে কোন দিনের মত ছাত্রছাত্রীরা বাইরে আইসক্রীম আর ছানাচুর, ফুস্‌্‌কা খেতেই ব্যস্ত দেখলাম।

একুশের ভোর বেলায় একুশকে খোঁজার জন্য আপনাকে যেতে হবে ‘এলিট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে।’ অনেকে একুশের ভোরের পদযাত্রা আগের দিন সেরে ফেলেছে। অধিকাংশই স্কুলে বিশাল ব্যানার টাঙিয়ে শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েছে। মুশকিল হল এসব প্রাঙ্গণে বাংলা ভাষা দৈনন্দিত অনুচ্চারিত থাকে রেওয়াজ অনুযায়ী। যখন পদযাত্রার শুরুতে বলা হয়-Boys & Girls! our procession Designs! বলা হয় তখন আর একুশকে খুঁজে পাই না। একটা বাচ্চা বলে উঠেMummy why without chappal (নগ্নপদে কেন) তখন আসলেই ‘একুশ’ মিছিল থেকে পালায়। সকালে প্রাতঃ হাটার সময় দুই বুড়া গল্প করছেদাদা। What is একুশে ফেব্রুয়ারি? বর্ষব্যাপী নতুন প্রজন্মের এমন ভাষায় বাংলাকে আসলেই নির্বাসনে যেতে হবে। এটা গোটা সমাজ তো দায় এড়াতে পারে না। রাষ্ট্রের উচিত ছিলকোমলমতি শিশুদের ৫ম বা ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত শুধু বাংলা মাধ্যমে অর্থাৎ সারা দেশে এক পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখা, ৬ষ্ঠ শ্রেণির পরে ইংরেজি মাধ্যম বা ন্যাশনাল কারিকুলামের শিক্ষা। এসব একমাত্র সরকারের পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু সমস্যা একটাইগোটা দেশের রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, উকিলডাক্তারপ্রকৌশলীসহ আপামর জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশ ‘কে.জি. স্কুল প্রীতিতে’ মগ্ন। এমন বাস্তবতায় ‘একুশকে’ খুঁজা দুষ্কর। বাইবাইটাটার ঠেলায় একুশের বর্ণমালার রং নিষ্প্রভ। হয়তো ‘একুশ’ আশ্রয় নিয়েছে “অসহায় বিত্তহীনদের” পাঠশালায়।

একুশের ভোরপ্রহরে [সকাল ৫ টায়] “শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থার” বাসিন্দাদের খুঁজতে বের হলাম। ফাল্গুনের সেই সকালটা বেশ কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল। যেন পরাজিত লজ্জার চাদরে ঢেকে আছে প্রকৃতি। পুরো শহরের দোকানের বারান্দায় সারি সারি ঘুমন্ত মানুষ। আশ্রয়হীন বোঝা যায়। তবে বস্ত্রহীন নয়। সবাই যা সম্বল তা দিয়ে ঢেকে নিস্তব্ধ নিদ্রায় মগ্ন। মশা বা হালকা যানের দ্রুত গতির শব্দ কিছুই এই মানুষগুলোর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় না। এটা এই সমাজে আশ্চর্যের ব্যাপারই বটে!

অনেকের দামি বড়ি খেয়েও ঘুম আসে না। আবার এরা বড়ি ছাড়াই ঘুমাচ্ছে ফুটপাতে। বৈষম্যপূর্ণ সমাজে এমনই হওয়ার কথা। পুরো রেয়াজউদ্দিন বাজার ও ব্যবসায়িক অন্যান্য আড়তসমূহে ভোর প্রহরে যে মানুষগুলো কাঁধে বোঝা বয় তারাই ‘ধনী’ নির্মাণের প্রকৌশলী। যে বয়সে আমার আপনার পরিবারের বাচ্চারা ঘুমায় যে বয়সে আমার আপনার পরিবারের বুড়োয়া আয়েশ করে সেই কচি বাচ্চা, তরতরে জেয়ান, বয়সের ভারে ন্যুহ বুড়া সবাই দৌড়াচ্ছে মাথায় কাঁধে বোঝা নিয়ে। পুরো এলাকা এসব মানুষের মেহনতের ঘাম ঝড়ে। আমি শুধু ভাবি এই মানুষগুলো ঘুমায় কখন? খায় কখন? তাদের পরিবার পরিজনরাই বা কোথায়? ২১ শের ভোর প্রহরেও এরা শুধু মেহনত করে পেট চালানোর প্রচেষ্টায় জীবনকে সত্যিই কলুর বলদ বানিয়েছে। এসব মেহনতী মানুষ কষ্ট করে? খায় কি? এরা কি সমাজ ব্যবস্থার বৈষম্যের শিকার না প্রকৃতির নিয়মের উপসঙ্গ?

সামাজিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানউন্নয়ন বিকল্প নীতি নির্ধারণী গবেষণা প্রতিষ্ঠান দেশের চার কোটি দরিদ্র (২০১৮ সালে) নিয়ে গবেষণা করে। এই দরিদ্ররা যা পায় তা কাজ করে। বৎসরে অনেকদিন কোন রোজগারই করে না। বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র নিরুপনের মানদণ্ড ১.৯০ ডলার বা ২০০ টাকা প্রায়। মনে রাখতে হবে ওরা সবদিন কাজ পায় না। গড়ে চারপাঁচ সদস্যের পরিবার। মাবাবাভাইবোন বাদ দিয়ে ৬০% দরিদ্র দৈনিক ২৮০ টাকা আয় করে। ৩০% দরিদ্র ৫০০ টাকা বা তার আশেপাশের আয়ের মধ্যে। তারা কি খায়? এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে ভাত, ডালডিম খায় ২৭% পরিবার। ডিমের দাম বাড়ার পর অনেকে ডিম বাদ দিয়েছে, ২২% পরিবার শুধু ভাত, সবজি খায়। ১২% মাসে ২ বার মাছ খায়। ২০০ পরিবারের মধ্যে ৩ পরিবার মাসে ১ বার মাংস খায়। মাসে সবদিন দুইবেলা খাবার না জোটার কথা বলেছে ২৮% পরিবার ১২ ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালেপত্রিকায় দ্রব্যমূল্য নিয়ে বিশদ প্রতিবেদনে এসব গরীবদের ক্রয়ক্ষমতা নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠে ক্ষুধার্ত বিলাপের টার্গেট ধরা হয়েছে। বর্তমান দ্রব্যমূল্য, মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব এই লক্ষকে টিসিবির লম্বা লাইনের মত দীর্ঘায়িত করবে। টিসিবির লাইন দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। তাই আসলে গবেষণা আর তথ্যেরও প্রয়োজন নাই। বৈষম্য বাড়ছে। কমার লক্ষণ নেই। সরকার এর প্রচেষ্টায় কমতি নেই, বরাদ্দেও ঘাটতি নেই। নীতি নির্ধারকদের ভাবার সময় এসেছে স্বাধীনতার স্বপ্ন শোষণহীন, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঘাটতি কোথায়? বিবর্ণ একুশ, বিবর্ণ দারিদ্র আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাবে?

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিপিসিকে আরো স্বচ্ছ ও গতিশীল করা এখন সময়ের দাবি
পরবর্তী নিবন্ধবাঁশখালীতে প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনী ও পুরস্কার বিতরণ