ভূগোলের গোল

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ৩ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ

খোদা কি শান!
চন্দনীমহল ভি দেখা

ভ্রমণ করার গুরুত্বের বিষয়ে অনেকের ধর্মগ্রন্থে বলা আছে। স্রষ্টার অপার মহিমা, বৈচিত্র্য, সমাজের উত্থান-পতন ভ্রমণকারীরা স্বচক্ষে দেখে অভিভূত হয়। সুবুদ্ধির মানুষরা ভ্রমন সম্বন্ধে চিন্তা করে। আমাদের দেশ অত্যন্ত শ্রেণি বিভক্ত সমাজ। বড়লোকেরা উত্তর গোলার্ধ ভ্রমণ করে। দরিদ্ররা নিদেনপক্ষে ভারতে জিয়ারত করে। মোদ্দা ক আসল জীবন সংগ্রামেই জীবনের ইতি ঘটে। সেখানে ভ্রমণ দেশে হউক বা বিদেশে হউক বিলাসিতা বৈকি! কবিগুরু সময়ের তুলনায় বিস্তর ভ্রমণ করেছেন। পরিশেষে আক্ষেপ-

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।

আমাদের দেশে ভ্রমণ বলতে কক্সবাজার, সিলেট আর পার্বত্য চট্টগ্রাম। আমি আভ্যন্তরীণ টুরিজমে অতি নীচের দিকে। ভ্রমনের গল্পের আগে ভ্রমণ সংক্রান্ত একটা মজার উদ্ধৃতি দিব।

দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর কিছু অঞ্চলে বৃষ্টি অত্যন্ত কম। আমাদের দেশের কাল বৈশাখী, মেঘদ-গর্জন, বিদ্যুৎ চমকানো দেখা যায় না। আমার এখানে এমনি এক রুক্ষ অঞ্চলের এক তামিল মেহমান এসেছিলেন। নিজ বাসার এক রুমে তাকে থাকতে দিই। মধ্যরাতে প্রচন্ড কালবৈশাখী ভারী বৃষ্টি, মেঘের গর্জন। দেখতে গেলাম মেহমান কেমন আছেন। দেখলাম বেচারা লাইট জ্বালায়ে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় বিছানায় বসে আছে। মেহমান জীবনে এরকম বৃষ্টি, তুফান আর বিদ্যুৎ চমকানো দেখেননি। বললেন-খোদা কি শান! বারিষ ভি দেখা! আমি অত্যন্ত আশ্চর্য হলাম। এত তুমুল বৃষ্টি মেহমান কখনো দেখেনি। খোদা কি শান!

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল খুলনা, বাগেরহাট, সুন্দরবন অঞ্চল যেতে হয়েছিল ছাত্র জীবনের কুমিল্লা ও খুলনা অঞ্চলের দুই বন্ধুর অনুরোধে। আমার জন্যও এটা খোদা কি শান্‌! চন্দনী মহল ভি দেখা! চন্দনী মহল খালিশপুরের পশুর নদীর পাড়ের এক প্রান্তিক গ্রামীন জনপদ।

কুমিল্লার ও খুলনার বন্ধুরা আমার অনুজ, আমরা বুলগেরিয়ায় পড়তাম পঞ্চাশ বছর পূর্বে। কুমিল্লার বন্ধু সিডনীর নগর পরিকল্পক, খুলনার বন্ধু মার্কিন মুলুকের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। দুজন আমাকে নিয়ে গেল খুলনায়। আমার ভ্রমণ বলতে ঢাকা ছাড়া আর কিছু নাই। পদ্মা সেতু দিয়ে পাড় হওয়া প্রত্যেক বালাদেশীর জন্য এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার। তবে প্রমত্তা পদ্মার জীর্ণ শীর্ণ অবস্থা আমাদের জন্য শংকার বিষয়। বড় বড় চর নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহকে ব্যাহত করবে। যা-হোক দক্ষিণ বঙ্গের বাড়িঘর-বিলঝিল আমাদের এলাকা থেকে ভিন্ন। রাস্তার বাজার গুলোও অন্য চাঁছের। তবে রাস্তা দারুণ। গাড়ি চলছে তো চলছেই। ৮০-৯০-১২০ কিমি এ ও চলতে পারে। গোপালগঞ্জ পার হয়ে বাগেরহাট ঢুকতেই অভাবনীয় দৃশ্য। পুরো মাঠ জুড়ে মাছ চাষ। পুরো খুলানা, মংলা, বাগেরহাট অঞ্চলে মাছ চাষ দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না কেন মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ ২য়/৩য় স্থানে। খুলনা শহর বেশ উন্নত।

অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও প্রচুর। কিন্তু প্রাক-স্বাধীনতা যুগে খালিশপুর জুড়ে যে বিশাল শিল্প অঞ্চল ছিল তা সময় পরিক্রমায় না বেড়ে স্থবির ও লয় প্রাপ্ত। খুলনার তৎকালীন নেতা খুলনাকে চট্টগ্রামের সমপর্যায়ের শহরে রূপদানের আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। খুলনায় আমার জন্য বিস্ময় ছিল সরকারি বিএল কলেজ। এটা এক বিশাল ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। কলেজের ভিতরের রাস্তা, মাঠ, মসজিদ-সব কিছুর মধ্যেই নান্দনিকতার ছাপ যেটা খুব কম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখা যায়। ব্রজলাল চক্রবর্তী নামে এক শিক্ষানুরাগী কোলকাতার হিন্দু-কলেজ বা প্রেসিডেন্সী কলেজের আদলে এই কলেজ স্থাপন করেন ১৯০২ সালে ২ একর জায়গায়। কিন্তু পরবর্তীতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবিলিয়শনের জন্য এই জায়গা অপ্রতুল হলে মোহসিন ফান্ড থেকে ৪০ একর জায়গা কিনে দেয়া হয়। খুলনা বিএল কলেজের পরবর্তী অগ্রযাত্রায় মোহসিন ফান্ড ক্রীত জায়গা বিরাট ভূমিকা পালন করে। এখানে তরুণ প্রজন্মের জানার জন্য উল্লেখ্য যে বাংলা গদ্য সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যায় পশ্চিম বাংলার স্থালীতে মোহসিন ফান্ডের বৃত্তি দিয়ে পড়াশোনা করেন।

খুলনা অঞ্চল মূলত নদী বিধৌত জনপদ। পুরো অঞ্চল ৫০০ বছর আগেও মনুষ্য বাসের জন্য সুবিধা ছিল না। বনজঙ্গল সাফ করেই এখানে জনবসতি বাড়তে থাকে। মুসলমান প্রধান এলাকায় পণ্য বিপনের জন্য গড়ে ওঠে গঞ্চ-যেমন বাকের গঞ্জ, কালীগঞ্জ, মোরেলগঞ্জ। হিন্দু প্রধান এলাকায় ‘হট্ট’ বা হাটসৃষ্টি হয়। যেমন-সেনহাটি, বাগেরহাট মোল্লাহাট, নয়াহাট ইত্যাদি। খান জাহান আলী পীরের সমসাময়িক ধনপতি সওদাগর নামে এক ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। তার ২য় স্ত্রী ‘খুলনার’ নামে তিনি খুলনেশ্বরী মন্দির নির্মাণ করেন। ওখান থেকেই খুলনা নামের উৎপত্তি।

আমি মার্কিন অধ্যাপক আলী আকবর ও সিডনীর নগরবিদ তালিবুল এর সাথে অধ্যাপকের বাসায় ছিলাম।

এলাকার জীবন সংস্কৃতির খোঁজ নেয়া আমার ভ্রমনের অন্যতম উদ্দেশ্য। এই অঞ্চলের তিনটি বিশেষ গ্রাম স্ব বৈচিত্র্যে বিশিস্ট। আকবর সাহেবের গ্রাম চন্দনী মহল, রবীন্দ্রনাথের শ্বশুর বাড়ি সেনহাটি ও রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষদের গ্রাম পিঠাভোগ। প্রভাতকুমার মুখ্যোপাধ্যায় শান্তি নিকেতনে দীর্ঘদিন কাটান। তিনি দক্ষ সাহিত্যিক। তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি চার খন্ডের রবীন্দ্রজীবনী। তছাড়া সতীশ চন্দ্রের যশোর খুলনার ইতিহাস ও বৃটিশ টি ডব্লিউ ফ্যারেলের বই দ্য টেগোর ফ্যামিলি আমাদেরকে পাঁচশ বছর পূর্বের খুলনার পিঠাভোগ গ্রামে নিয়ে যায়। ওখানে রবীন্দ্রনাথের বসত ভিটা বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতাত্বিক স্থাপনা, রবীন্দ্র সেই প্রজন্মের পূর্বপুরুষরা সাধারণ মানুষ ছিলেন। তারা পূজা অর্চনায় লিপ্ত ছিলেন বলে স্থানীয়রা তাদেরকে ধর্মীয় আবেগে ‘ঠাকুর’ সম্বোধন করত। সেই বংশধারার সংযোগ রাখতে হয়তো রবীন্দ্রনাথকে সেনহাটা থেকে বিয়ে করানো হয়।

পড়ন্ত বিকেলে তালিবুল আর আমাকে শেখ আলী আকবর (ইউএসএ) তার গ্রাম চান্দনী মহলে নিয়ে যায়। পশুর নদীর একপাড়ে শহর। আরেকপাড়ে চন্দনীমহল গ্রাম। নৌকা দিয়েই খেয়া পার হতে হয়। রূপসা ভেরব আর পশুর দিয়ে ঘেরা আকবরের গ্রাম। চার-পাঁচশ বছরের পুরোনো গ্রাম। তখন ছিল বিত্ত-বৈভব। এখন ক্ষয়িষ্ণু এক জনপদ। আকবর নাকি ৩-৪ টা নৌকা বদল করে হেটেই প্রাইমারী। হাই ও কলেজে যেত। এখনো চন্দনীমহলের “উন্নয়ন অবয়ব” স্থিত। শীতের বিকেলে সবাই রাস্তার মোড়ে, নদীর পাড়ে আড্ডায়। লোকজন ভ্যানগাড়িতেই চলাচল করে। হিন্দু-মুসলিম পাশাপাশি ঘর। সন্ধ্যায় আরতি দিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মন্দির চত্বরে জমায়েত হয়। মজার বিষয় হল সুদৃঢ় মার্কিন মুলুক থেকে আসা আকবর ভাইকে মাঝি-মাল্লা, ভ্যানওয়ালী কেউই ভোলেনি। সনাতন ধর্মী লোকজন ও দেখি কোলাকুলি করছে। “কবে আইছেন আকবর ভাই?” দারিদ্র ক্লিষ্ট জনগণ এর ভক্তি দেখে বিমোহিত হলাম। সব গ্রাম যেমন ঢাকাকে সমৃদ্ধ করে চন্দনীমহল ও তেমনি। শুধু দরিদ্ররা এই গ্রামে পড়ে আছে।

আকবরের স্কুল জীবনের বন্ধু কালীদাশকে জিজ্ঞেস করলাম এই গ্রামের নাম চন্দনীমহল কেন হল? আগে নাকি বেশ জ্ঞানী গুণী লোক ছিল এই গ্রামে। তাদের সুখ্যাতি চন্দন এর সুঘ্রান এর মত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই সূত্রেই গ্রামের নাম চন্দনী মহল। আরেক জনশ্রুতি মতে চন্দনী নামে এক সুন্দর তরুণী ছিল। সেনহাটা গ্রামের জমিদাররা তাকে বিয়ে করতে চাইল। কিন্তুু ‘চন্দনী’ রাজী হল না। সেনহাটা অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের শ্বশুর বাড়ির গ্রামের জমিদাররা ‘চন্দনী’কে নিয়ে আসর বসতি। তার থেকেই এই গ্রামের নাম চন্দনী মহল। বাংলাদেশে এরকম আরো কত গ্রাম রয়েছে। ওদের জন্য ঢাকার নগরের জৌলুষদীপ্ত জীবন অচেনা এবং জগৎ। এসব গ্রাম থেকেই উঠে এসেছে কত তালিবুন, কত আলী আকরব। যাদের বসতি হয়েছে পৃথিবীর অন্য মহাদেশে অথবা ঢাকায়। চন্দনী মহলের আজকের বাসিন্দারা যোজন মাইল দূরে ঢাকা থেকে। আজকে ভাববার বিষয় ভৈরব-রূপসা-পশুর বিধৌত কিছু জনপদ যাদের জীবনই সকাল-সন্ধ্যা অন্নের সংগ্রাম তাদেরকে নিয়েই কি স্বদেশ? না শুধু এলিটদের নিয়ে? হয়ত আজকের প্রেক্ষাপটে ২য়টাই সত্যি। সম্প্রতি লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্টে এক সাদা মানুষ এক ঢাকাগামী প্যাসেঞ্জারকে জিজ্ঞেস করল-কোথায় যাবে?

বাংলাদেশ
বাংলাদেশ কোথায়?
বাংলাদেশ ঢাকায়।

সত্যিই অবাক হবার কিছু নেই। বাংলাদেশ যেন ঢাকায়। অন্য জনপদ? দেখলে মিলাতে কষ্ট হবে। দক্ষিণ ভারতের বন্ধু যেমন বৃষ্টি দেখে বলেছিল-খোদা কি শান! বারিষ ভি দেখা! আমাদের মত মানুষেরও বলতে ইচ্ছে হয় খোদা কি শান! চন্দনী মহল ভি দেখা।

লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ
পরবর্তী নিবন্ধঅপহরণের ৬ দিন পর কাউখালীর ৩ শ্রমিক হাটহাজারীতে উদ্ধার